খুব ছোট্ট বয়সে মানিকের মা মারা যায়। মাকে ওর একদম মনে নেই। নানীর কাছে মানুষ মানিক।
বাবা তার সাধ্যের মধ্যে কোন কিছুরই অভাব অপুরনীয় রাখেননি। তবে তিনি যা পুরণ করেছেন তা সব দেখা যায় মাপা যায়। অবশ্ব্য ওগুলো না হলে জীবন বাচে না। তবে মায়ের অভাব কি দিয়ে পূরণ করবেন তিনি!
ছোট থেকেই একটা বঞ্চিতের মানষিকতা নিয়ে বড় হয়েছে মানিক। ওর ভাবনায় কেউ ভালো বেসে কিছুই দেয়নি ওকে। ও যা কিছু পেয়েছে তার সব কিছুই ওর নিজের অর্জন। তায়তো ওর বিচারে কেউ কোন কিছু পাওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্তেও যদি এমনিতেই ভালবাসা বা হৃদয়ের টানে কেউ যদি তাকে তা দেয় তবে সেটা মানিকের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে।
ওর মায়ের মুখটা পর্যন্ত ও মনে করতে পারে না। কারণ এক বছর বয়েসের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। একটা মানুষ ও পায়নি যাকে জিজ্ঞেস করে মায়ের মুখটা কেমন ছিল।
বড় হয়ে অনেক বার ভেবেছে নানীকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস হয়নি, পাছে অতি আদরের সন্তান হারানোর চাপা ব্যথাটা জেগে ওঠে ওর মনে নতুন করে।
এসএসসি পরীক্ষায় মানিক বোর্ডের মধ্যে প্রথম হলো। নিঃসন্দেহে এটা অনন্য সাধারণ ঘটনা। মানিকের বাবা তখন সিঙ্গাপুরে থাকেন। সেথান থেকেই টেলিফোন করে ওকে অভিনন্দন জানালেন বাবা। যার পর নেই খুশি হয়ে ওর কি দরকার টেলিফোনে জানতে চায়লেন। আদর করে তিনি বললেন- বাবা তুমি কি সিংগাপুরে আসবে কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে, আমি আসবো তোমাকে নেয়ার জন্যে।
মানিক ভালো করেই জানে ওটা বাবার মুখের কথা বা কথার কথা নয়, অন্তরের কথা। মানিককে খুশী করার জন্য তার আর্থিক সামর্থের মধ্যে যা সম্ভব বাবা তা অবশ্যই করবেন, মানিক সেটা জানে। কিন্তু মানিকের যা দরকার তা যে সিঙ্গাপুরে কেন পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না সে কথা বাবাকে বলতে পারলো না মানিক। শুধু বললো দোয়া করো বাবা।
একই বছরে ওর বন্ধু শরিফ ফেল করলো। ওর বাবা মা ছুটে এলেন, ভীষণ উদ্বিগ্ন। স্কুলের প্রিনসিপালের সাথে কত কথোপকথন করলেন। বোর্ড থেকে ওর খাতা কল করে পুনঃপরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। যাহোক, কিছুই করতে পারলেন না ওরা ছেলের জন্য। শরিফ ওর বাবা মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কান্না কাটি করে মনটা হালকা করে নতুন আশায় বুক বাধলো। ভাগ করে নিয়ে ওর সব যন্ত্রনা নিঃশ্বেষ করে ফেললো।
সিঙ্গাপুরে বাবার বড় ব্যবসা ছাড়াও তার অন্য একটা স্ত্রী আর সংসার আছে সেখানে। ও পক্ষের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়েও আছে। ব্যবস্যা আর সংসার দুটোর টানে তিনি ওখানেই থাকেন।
মানিকের মায়ের সাথে ওর বাবার পরিচয় মায়ের স্কুল জীবনের প্রায় শেষের দিকে। মানিকের মা তখন হলি হোমস কলেজিয়েট স্কুলের এইচ এস সি শেষ বর্ষের ছাত্রী। হোষ্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেন।
বাবা তখন পড়াশোনা শেষ করে পৈত্রিক ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছেন। উত্তরাধীকার সূত্র ধরে ইণ্টারন্যশনাল রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর একজন ডাইরেক্টর তিনি।
হলি হোমসের নতুন ভাবে তৈরীকৃত মূল স্থাপনার কাজটা ওরাই করছিলো। সে হিসাবেই ঐ কলেজ চত্তরে যাতায়াত থেকে মায়ের সাথে পরিচয় বাবার।
পরিচয় থেকে ভালোলাগা ভালোবাসা এবং বিয়ে।
কাউকে না জানিয়ে ওরা নিজেরা বিয়ে করে। পড়াশোনা শেষ হতে হতেই ওর মা গর্ভধারণ করেন। বাড়ীতে আসার পর বেশী দিন সেটা গোপন রাখা যায়নি কারণ পেটের বাচ্চা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগলো।
নানী সহজে ব্যপারটা মেনে নিলেও নানা কিছুতেই মেনে নিলেন না। তিনি চিরকালই রগচটা আর একরোখা স্বভাবের। ব্যপারটা যেন ওকে পুরোপুরি জ্ঞানশূণ্য করে দিল। তিনি নির্মম ভাবে মেয়েকে একদম ঘরে বন্দী করলেন।
বাবার সাথে মায়ের যোগাযোগটা একদম বন্দ হয়ে গেল।
মায়ের এই বন্দীদশায় মানিকের জন্ম। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন নিজের সন্তানকে দেখতে। কিন্তু কোন ফল হয়নি।
ওদিকে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা যে কিভাবে মানানসই করে মেয়ের জীবনকে চলতে দিবেন তা ওর নানার জানা ছিল না। রাগের অতিশয্যে বিষয়টি গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখলেন না তিনি।
শেষে ওই বন্দীদশায় মারা গেলেন মানিকের মা। বাবাকে কোন রকম খবর না দিয়েই মাকে সমাহিত করা হলো।
পরে জানতে পেরে উদ্ভ্রান্তপ্রায় বাবা সব কিছুকে উপেক্ষা করে ছুটে এলেন। মানিককে বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলো বাবা সেদিন। যাহোক, নানীর অনুরোধ ও যুক্তিতে বাবা কয়েক বছরের জন্য মানিককে রাখলো নানীর কাছে।
তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা গুটিয়ে সিংগাপুরে পাড়ি জমালেন। মানিক নানীর কাছে বড় হতে লাগলো।
এত সব কিছু মানিক নানীর কাছ থেকে শুনেছে অনেক পরে।
সিংগাপুরে ওর বাবার জীবন সম্মন্ধে নানী আর কিছুই জানতেন না। তবে বাবা প্রতি মাসে কোন না কোন ভাবে মানিকের খবর রেখেছে।
বাবার জীবনটা আঘাতপ্রাপ্ত হলেও থেমে থাকেনি। সিংগাপুরে এক মালে পরিবারের মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে হয়। ব্যপারটা বাবা নানীকে জানিয়েছিলেন।
মানিকের বয়স যখন প্রায় বারো বছর তখন বাবা এলেন মানিককে সিংগাপুরে ওর কাছে নিয়ে যেতে। ততেদিনে বাবার নতুন সংসারে আরো দুটো সন্তান যোগ হয়েছে।
নানী কিছুতেই মত দিলেন না। সব নিরেট বাস্তবতাগুলো সামনে এনে নানী বাবাকে বুঝালেন। মানিকের মায়ের একটা ছায়া বাবা সব সময় নানীর মধ্যে দেখতে পেতেন তায় তিনি কখনো তার কথা ফেলতে পারতেন না।
দুজনে মিলে মানিকের লেখাপড়া ভবিষ্যৎ ইত্যাদি চিন্তা করে ওকে দেশের কোন অভিযাত রেসিডেনসিয়াল স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন ওরা।
সেই থেকেই মানিকের হোষ্টেল জীবনের শুরূ।
যাহোক ব্রিলিয়ান্ট একটা রেজাল্ট করার মত ওর জীবনের এত বড় একটা অনন্য পাওয়ার ভাগীদার মানিক কাউকেই করতে পারলো না।
সিংগাপুর থেকে টেলিফোনে অভিন্দন জানানো বা এই খুশিতে সিংগাপুর থেকে ঘুরে আসা ইত্যাদির একটা প্রচার মুল্য অবশ্যই আছে। তা দিয়ে অপরের কাছে হয়তো নিজের মুখটা বড় করা যায় কিন্তু অন্তর ভরবে কি দিয়ে!
কষ্টটা শুধু না পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ঐ না পাওয়া গুলোকে সবার দেখা থেকে আড়াল করতে না পারার যন্ত্রনাটা আরো ভোঁতা।
নিজের পরিমাপে মানিক একদম সাধারণ একজন মানূষ তায় ওর জীবনের ঘটনাগুলোও সাধারণ হওয়ারই কথা।
নিজে অতি সাধারণ কিন্তু জীবনের ঘটনাগুলো অসাধারণ!
বাবা মায়ের সম্পর্ক নিয়ে আর মানিকের জন্ম কাহিনী নিয়ে আড়ালে আবডালে অনেকে মুখোরোচক কথাবার্তা বলে। ওদের বিভিন্ন আপনজনেরাও আছে এদের মধ্যে।
বিশেষ করে বিভিন্ন কারণে ওকে যারা হিংসা করে তারাই সুযোগ মত ওর এই পৃথিবীতে আসাটা নিয়ে নানা ধরণের মুখোরোচক গল্প বলে ওর এ জগতে আসাটাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
ওর বন্ধুদের সবার জীবনের গল্পগুলো আলোকিত চকচকে, যত প্রকাশ করা যায় ততোই চাকচিক্য বেড়ে যায়। কিন্তু ওর জীবনের গল্পগুলো আঘাতপ্রাপ— বিকৃত, অন্ধকারেই ওরা স্বস্তিতে থাকে। কষ্টগুলো ওর একান্ত নিজের, কিন্তু যখন সমাজের কিছু ছিদ্রান্বেষী মানূষ পচা গলিত পুঁজ খেতে ভালবাসা কিটের মত সেগুলোকে খুচিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে আনন্দ করে তখন সেগুলো অসহনীয় হয়ে ওঠে।

তুমি সর্বদ্রষ্টা মহাস্রষ্টা, আমি নগণ্য পথভ্রষ্ট তুচ্ছ সৃষ্ট
যা চাও তাই তুমি দাও, যত জ্বালা যন্ত্রনা কষ্ট।
আমি অতি অসহায়, বাচি তোমারই দয়াই, অধম মানুষ মাত্র।
থাকতে প্রাণ সইবো তোমার বিধান, নীরবে নিভৃতে, তাতে ভরে ভরূক অশ্রুতে, মম নেত্র।

সে যন্ত্রণা প্রভু যদি অসহনীয় হয় কভু, বলি কথা আকাশের সাথে
অগ্নিস্ফুলিঙ্গ চোখে যদি থাকে, সেত বিধাতা আমাতে
অন্যের কি আসে যায় তাতে!

জানি, যা কিছু নেবে তুমি হায়, সবটুকু তার খাটি সোনা হওয়া চায়
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বের কর সে সোনা, কেউ করিনি তোমাকে মানা,
শোধ হোক আছে যত সব দেনা!
জ্বালা না কমাও ক্ষতি নেই তাতে, সে হিসাব গুধু তোমাতে আমাতে।

তোমার সৃষ্টি তুমিই জ্বালাও, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছায় করে দাও।
কার কি আসে যায় তাতে! সে হিসাব কেবল তোমাতে আমাতে।
আকুতি শুধু- বাচাও আমাকে, পচা পুঁজ ঘাটা কিটগুলো থেকে।

কাকে বলবে ও কথাগুলো।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.