অমৃতের সন্ধানে -১ 

 

ভোর রাত থেকে বুকের বা দিকটা পিন পিন করে ব্যাথা করতে থাকায় হটাৎ করেই ঘুমটা ভেঙেছে মানিকের। ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে অসাবধানাবসতঃ নিজের হাতের ধাক্কায় খাটের পাশে টি টেবিলে রাখা ওর পুরূ লেন্সের চশমাটা খালি মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
নিরূপায় মানিক কোন রকমে অনুমানের উপর ভর করে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে সুইচ টিপে লাইটটা জ্বেলে ব্যথার ট্যাবলেটটা খেয়ে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু কিছুতেই চোখ দুটো আর এক করতে পারলো না। বাকি সময়টুকু জেগেই কাটলো। নানা চিন্তা এসে মনের কোণে ভীড় জমাতে লাগলো।
পুরনো আমলের জমিদার বাড়ীর আদলে বানানো ওদের বাড়ীটা। প্রায় পঞ্চাশ একর জায়গার উপর ভিটে বাড়ীটা। পুরো জায়গাটা পাচিল ঘেরা। পূর্ব দিককার সীমানা প্রাচিরের প্রায় গা ঘেসে বয়ে চলেছে শীতলক্ষা। বর্তমানে শীর্ণ দশা হলেও দুপাড় দেখে ওর ভরা যৌবনের চেহারাটা সহজেই আঁচ করা যায়।
বলতে গেলে ওদের আপন আর কেউ থাকে না এখানে। সবাই বাইরে বাইরে জীবিকার তাড়নায়।
মানিকও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। জীবন জীবিকার তাগিদে তাকেও ছুটে ছুটে বেড়াতে হয়েছে দেশ দেশান্তরে।
এযাবত জীবনটাকে অনেক ভাবে অনেক নীরিখে দেখলো মানিক। কিন্তু জীবনটা ওর কাছে প্রহেলিকাই রয়ে গেল। আর তায় কোন কুল কিনারা না পেয়ে অবশেষে ফেরত আসলো একদম উৎপত্তির কাছে।
কয়েক বছর হলো মানিক ওর সারা জীবনের সঞ্চয় ঢেলে দিয়ে মূল বসত বাড়ী থেকে একটু দূরে বসত ভিটারই ফাঁকা জায়গায় একটা হাসপাতাল তৈরী করেছে। এটা ওর অতি আদরে লালিত স্বপ্ন পুরনের চেষ্টা।
হাসপাতালের প্রতিটি ঈট পাথর আর বালু কনার মাঝে ওর জীবনের গল্প যেন লেখা হয়ে আটকে আছে।
একদম গোড়া থেকেই ও ওর সব ভালোবাসা আর আবেগের সবটুকু ঢেলে দিয়ে হাসপাতালের সাথে নিজেকে নীবিড়ভাবে জড়িত করেছে মানিক। জীবনের স্বার্থকতা খোজার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে মানুষের সেবার মধ্যে।
কিন্তু অবশেষে জীবনের বিভিন্ন সহজাত টানাপোড়ানের কাছে অসহায় হয়ে সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মানিক। সেই প্রয়াসেই একটা ট্রাষ্ট গঠনের মাধ্যমে হাসপাতাল পরিচালনার সব দায়ীত্ব গত কালই ট্রাষ্টের উপর তুলে দিয়ে মানিক সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে একরকম গুটিয়ে নিয়েছে বলা চলে।
বাড়ীর যে অংশটাতে মানিক বর্তমানে বসবাস করে সেটা ওদের বিশাল বসত বাড়ীর সামনের একটা ছোট্ট অংশ। চারিদিকে উচু চওড়া বারান্দা দেয়া দোতলা এই অংশটা।
বাড়ীতে একজন কেয়ার টেকার সহ কাজকর্ম করার জন্য আর দুজন মানুষ আছে। ওরাই ওদিকটাতে বসবাস করে।
এটা ওর পর দাদার ভিটা। তিনি অত আগে কেন যে সখ করে এত বড় জায়গা নিয়ে নদীর ধার ঘেঁসে বাড়ীটা বানিয়েছিলেন তা মানিকের জানা নেই। নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন ছিল তার মনে। কিন্তু খেয়ালী জীবন হয়েতো খোঁজ করেনি তার কোন কিছুই।
তিনি খুব দূরদর্শী ছিলেন নিঃসন্দেহে। পুরো ভিটের জায়গাটা আশপাশ থেকে বেশ অনেক উচু করা। বড় বড় বেশ কয়েকটা দিঘি আছে ওদের ভিটের জমিতে। ওগুলোর মাটি দিয়েই পুরো জায়গাটা উচু করা। এর প্রয়োজন এতদিনে অনুভূত হচ্ছে।
পুখুর গুলোতে মাছের চাষ হয়। ওগুলো ট্রাষ্টের আওতায় আনার ফলে এর থেকে হাসপাতালের জন্য একটা স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। আর অতি বর্ষায় নদীর দুকুল ছাপিয়ে বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গেলেও এ ভিটে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকে।

আষাঢ় মাস। এবার আগে ভাগেই বর্ষা নেমেছে। বর্ষাও হচ্ছে প্রচুর। বন্যার আশংকা করছে সবাই।
বুকের বা দিকটা কিন কিন করে ব্যথা করেই চলেছে। ভারী অস্বস্তি লাগছে শরীর মন দুটোতেই। ভোরের আলো ফুটতেই লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে কোন রকমে উপর তলা থেকে নিচে নেমে এসেছে মানিক।
নামতে বেশ কষ্ট হয়েছে। থেমে থেমে দম নিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে নেমেছে। আজই প্রথম অনুভূত হয়েছে সিড়ির ধাপগুলো বেশ খাড়া ও বন্ধুর।
এদিকটা অর্থাৎ বাড়ীর সামনের দিকটা একেবারে ফাঁকা। সামনে বেশ কিছু খোলা জায়গা তারপরেই বাউন্ডারী পাচিল। সে আমলের প্রকান্ড একটা লোহার গেট কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। গেটটা পুরনো শুধু একটু আধটু মেরামত করা হয়েছে। গেটের দুধারের পিলার দুটোর গা ঘেসে দুটো শিউলি ফুলের গাছ মাথা উচু করে দাড়িয়ে। ওরা যেন নিজেদেরক নিঃশ্বেষ করে সকলের সেবাই উৎসর্গকৃত মহাপ্রাণ।
বাউন্ডারী পাচিলটার গা ঘেঁসে বাইরে দিয়ে সরূ একটা পিচ ধালা রাস্তা আর তার পর দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠ।
কোথাও কোন কর্মতৎপরতা চোখে পড়ছে না। আজ কেবল প্রকৃতির তৎপরতার পালা যেন।
সামনের উচু বারান্দার উপর রাখা ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছে মানিক। একটু শীত শীত পড়ায় চাদরটা গায়ে পেচিয়ে নিয়েছে।
পুরনো বাউন্ডারী পাচিলটা বয়সের তাগিদে বসে যেয়ে বেশ নিচু হয়ে যাওয়াই বারান্দায় বসেই পাচিলটার উপর দিয়ে সামনে মাঠ প্রান্তর সব দেখা যাচ্ছে যতদূর দৃষ্টি যায়।
চশমাটা না থাকায় খালি চোখে সামনের যা কিছু সব একই রকম মনে হচ্ছে আজ। কোন ভেদাভেদ চোখে পড়ছে না। না মানুষের মুখের বা গাছপালার কোন কিছুরই ভিতর যেন কোন পার্থক্য নেই আজ।
চশমাটা চোখে থাকলে সবাইকে সবকিছুকেই আলাদা আলাদা মনে হয়। চশমার লেন্সের ফাঁক দিয়ে মানুষের মুখগুলো ভালো ভাবে চোখে পড়ে। তাতে চেনা মানুষ গুলোর দেখানো মুখের পিছনে লুকিয়ে রাখা অন্যান্য অনেক মুখের চেহারাও দেখা যায়।
প্রতিটি মানুষই যেন অনেক চেহারা অনেক রূপের সমাহার। এটা বোধহয় মনুষ্য জগতের বড় একটা দুর্বলতা।
সীমাবদ্ধতায় ভরা মানুষ সবাই কত কিছু হতে চায় কত কিছু করতে চায়। আর উদ্দেশ্য সাধনে কত পথই না অবলম্বন করে। বেধে দেয়া গন্ডিও অতিক্রম করতে চায়।
জীবনের গন্ডির একদিকের পরিধি পার হলে পশুত্বের রাজত্ব আর অপরদিকটা দেবালয়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মানুষ কোন দিকের গন্ডিই পার হতে পারে না। তায়তো মানুষ যেমন সর্ব শক্তি নিয়োগ করেও যেমন জানোয়ার হতে পারে না তেমনি সব কিছু বিলিয়ে দিয়েও অতিমানব হওয়া কখনোই সম্ভব নয় কোন মানুষের পক্ষে।
মানুষ মানুষই। ক্ষেত্র বা সময়ের তারতম্যে ভালো খারাপের আর্বিভাব মাত্র।
এ মুহুর্তে মানিকের মনে হচ্ছে চশমাটা না থাকাতেই বরং ভালো হয়েছে। সব কিছু একই রকম মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। চোখ বন্দ করলে যে এতকিছু দেখা যায় আর কান বন্দ করলে যে এতকিছু শোনা যায় আগে মানিকের তা জানা ছিল না। এ যে অন্য এক জগত যার খোজ মানিকের অজ্ঞাত ছিল।
-জীবনটায় কেটে গেল ইন্দ্রিয়ের খাঁচায় বন্দী হয়ে ইন্দ্রিয়েরই তাড়নায়!
কথাটা ভাবতেই বুকটা স্ফিত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
আজ এই একটানা বর্ষন যেন প্রথিবীর সব কিছু থেকে মানিককে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নিজেকে মানিক আজ একেবারে নিজের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে।
কতকিছু দেখছে শুনছে অনুভব করছে আজ। একাকী নীরবে নিভৃতে বসে বসে মনে হচ্ছে মানুষের সব ইন্দ্রিয়গুলো মিলে মানুষের সকল অনুভব অনুভূতির পরিধি ছোট সংকীর্ণ করে দেয়, এক একটা সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। ছিদ্রান্বেষণ করে ভেদাভেদ সৃষ্টি করাই যেন ওদের একমাত্র কাজ।
কিন্তু আজ এই মুহুর্তে কোন সীমাই ওকে বেধে রাখতে পারছে না। কোন পিছু টান নেই ওর। সামনে এগোনোর কোন তাড়াও নেই।
মানিক পাখীর পালকের মত হালকা আজ। ওর বিচরণ আজ অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায়।
জীবনের ঘটে যাওয়া সবকিছু রেকর্ড করা ক্যাসেটের মত এক এক করে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে। তার কিছু পরিষ্কার জীবন্ত আর কিছু ঝাপসা। জীবনের অভিজ্ঞতা ওর মনে বিশ্বাস জুগিয়েছে যে বাকি যেটুকু আছে তাও বিধাতার পূর্ব রেকর্ডকৃত পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলবে। রেকর্ডের শেষ অবধি সবাইকে যেতেই হবে।
মানুষের জীবন প্রকৃতপক্ষে সিনেমার কাহিনীর এক একটা চরিত্রের মত। সিনেমার চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবের চরিত্রের কিছু কিছু মিল আছে কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোন অস্তিত্ব নেই। তবে কেবল একটা ব্যপারে দর্শকরা নিশ্চিত সব চরিত্রেরই শুরূ আর শেষ আছে। মধ্যের অংশটা পুরোটাই অনিশ্চিত কেবল কাহিনীকারের সম্পুর্ণ ইচ্ছাধীন।
সিনেমার কাহিনীকারের রচিত এক একটি জীবন যা বিশাল পর্দার ভেষে ওঠে তা লক্ষ কোটি দর্শকের এক এক জনের জীবনের এক একটা অংশ। দর্শকরা পর্দায় ছবি দেখার সময় নিজেকে নিজেদের পছন্দমত এক একটা চরিত্রের সাথে একাত্ম ভেবে ঐ চরিত্রের মানুষ হয়ে ওঠে। ইন্দ্রিয়ের নল দিয়ে ওদের সুখ দুঃখ ব্যাথা বেদনা প্রতিটি জীবনের শরীর মনে প্রবেশ করে ওদের দুঃখে নিজের চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, দেহের বিভিন্ন অংশে ব্যাথা অনুভব করে আর সুখগুলো দেহ মন আন্দোলিত করে নিজ নিজ পছন্দ মত জীবনকে এগিয়ে নিতে চায় প্রতিটি জীবন।
পর্দার ছবি শেষ হলে মনের গভীরে সবাই নানা পরিকল্পনার জাল বুনে নানা রকম প্রচেষ্টা চালায় নিজের জীবন নিয়ে। কিন্তু হায়! কোন কিছুই নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না। চলে মহা পরিচালকের ক্যামেরায় ধারণকৃত পূর্বনির্ধারিত পথে।
কাহিনীকারের কাহিনী একবার ক্যামেরা বন্দী করে বাজারে ছাড়লে সেটা যেমন আর কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তেমনি বোধহয় শুরূ হওয়ার পর প্রতি জীবনের জন্য নির্ধারিত সব কিছুর স্বাদ একেকটা জীবনকে অবধারিত ভাবে শেষ অব্দি গ্রহন করতেই হয়।
অতি কষ্টে পড়ে সহ্যের সীমা যখন আর ধরে রাখতে পারে না তখন কেউ কেউ কাহিনীতে তার অংশটা কাট ছাট করে কিছু অংশ বাদ দিতে চায় বা অতি সুখের দিনে তা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটায় ঘটে না। সৃষ্ট জগতে মানুষ যে বড়ই অসহায়।
হায়রে মানুষের জীবন! কোন সময় যদি কোন চরিত্রের কোন ঘটনা বা মুহুর্ত তার নিজস্ব চিন্তা চেতনার সাথে আংশিক বা কদাচিত পুরোপুরি মিলে যায় তাহলে সে সেটাকে নির্জের অর্জন ভেবে নিজেকে বাহবা দিয়ে তৃপ্ত হয়।
বিশাল পর্দায় দেখা কাহিনী দেখতে দেখতে মন্ত্রমুগ্ধ কোন জীবন যদি নিজের শরীরে জোরে চিমটি কেটে মোহটা ক্ষনেকের জন্য ভাঙতে পারে বা নিয়তি জোরে ধাক্কা দিয়ে কাউকে মোহমুক্ত করে, তাহলেই সকলেই নিজের অস্তিত্বটা বা অসহায়ত্ত্ব টের পায়।
কিন্তু হায়রে জীবন, পরোক্ষনেই বিশাল পর্দায় সংঘটিত ঘটনার রূপ রস গন্ধ যখন ইন্দ্রিয়ে দোলা জাগায় তখন অবুঝ জীবন আবার ভ্রমে ডুবে যায়।
জীবনটা অতৃপ্তির। কিন্তু মানুষ এক একটা বাহানা খুজে অতৃপ্তির ভার কিছুটা লাঘব করতে চায়। একটা অমৃতের স্বাদ অন্বেষণে প্রতিটি জীবনই তৎপর। সে স্বাদ যেন প্রতিটি জীবনের চেনা। তায়তো তারই সন্ধানে ব্যপৃত প্রতিটি জীবন।
অদ্ভুত নিয়ম বিধাতার।
সব মানুষই জীবনের বাকি যেটুকু আছে সে সম্পর্কে তার অবুঝ মনের গভীরে একটা স্বপ্নের জাল বোনে। স্বপ্ন দেখে দেখেই প্রতিটি জীবন নিজ নিজ সময়টুকু পার করে। একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে নতুন করে অন্যটা শুরূ করে।
জীবনটা যেন স্বপ্ন দেখার লুকোচুরি খেলা।
স্বপ্ন দেখার আকাংখা প্রতিটি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। এটা বিধাতার এক অপূর্ব দান।
জীবন চলার ব্যপারটা বিধাতার একচ্ছত্র কর্তৃত্বাধীন। আর স্বপ্ন দেখার ব্যপারটা বোধহয় বিধাতা মানুষের কর্তৃত্বাধীন করে দিয়েছে।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.