অসহায় মানুষ -২২

 

একটু বাদেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে একটু একটু করে। সব আধার কেটে পরিষ্কার হবে চারিদিক। জেগে উঠবে পৃথিবী, সব কিছু পিছনে ফেলে শুরূ হবে নতুন আর একটা দিন।
খোলা জানালার পাশে দাড়ালো প্রদিপ।
সবই ঠিকঠাক আছে আগের মত। কোন কিছুরই কোন পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তনটা ঘটেছে কেবল প্রদিপের। তাও বাইরে বা পারিপার্শ্বিক কোন কিছুতে নয়। যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ ওর মনের ভিতর। তার বিন্দু বিষর্গও প্রদিপ ছাড়া অন্য কেউই জানে না।
ও আল্লারাখা আর দোলনের গর্ভজাত সন্তান। জন্ম দিয়েই দুঃখিনী মা বিদায় নিয়েছে, আর নিরক্ষর বাবাও কিছু দিন আগ পর্যন্ত জানতো না ওর কোন খোঁজ।
কি করবে এখন প্রদিপ!
ভাবছিল গভীর ভাবে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে।
না কি, কিছুই করবে না ও! যেমনটি চলছিলো তেমনিই চলতে দেবে সব কিছুকেই।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব! যা ঘটেছে তা যে ওর অস্তিত্বকেই প্রশ্নের সন্মুখিন করে দিয়েছে।
অবহেলিত বা বঞ্চিত যারা চিরকালই তাদের পাশে দাড়িয়েছে প্রদিপ, হৃদয়ের তাড়নায়। হতভাগ্য যারা তাদের কারো জন্য কিছু না করতে পারলেও তাদের পাশে দাড়িয়ে ওদের কষ্টের ভাগিদার হয়ে তার ভার লঘু করতে চেয়েছে।
আল্লারাখা আর অন্তরার সাথে ঘনিষ্টতার সুত্র সেটায়। ওরকম অশিক্ষিত কর্মজীবি একজন মানুষের অন্তরার মত এজন সুশ্রী মার্জিত কন্যা খুব অবিশ্বাস্য আর বেমানান লেগেছিল ওর কাছে। এ ব্যপারটি ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে প্রদিপের মনে প্রকৃত অর্থে ওদের সম্পর্কটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
প্রদিপ তার অতল অন্তরে একদিকে গভীর শ্রদ্ধাবোধে আপ্লুত হয়ে আল্লারাখাকে সফল একজন বাবার অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্যদিকে বাবার আদর্শে লালিত অন্তরা, যে সমস্ত চাক্ষুস আর গুনগত পার্থক্যকে পদদলিত করে আল্লারাখাকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে তা ওর আছে অন্তরাকে অনন্য মনে হয়েছে। অন্তরাকে সে ওর ভাবনায় অনেক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। অন্তরা আর আল্লারাখা এ দুটি মানুষ প্রদিপের কাছে আদর্শ এবং তাদেরকে সকলের কাছে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় প্রদিপ।

ওর এ ভাবনার মধ্যে কোন খাদ ছিল না।
কিন্তু কি হচ্ছে এ সব এখন! ওর সব চিন্তা চেতনা যে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে!

আল্লারাখা ওর জন্মদাতা বাবা। এত চরম সৌভাগ্যের ব্যপার।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ওর মনের ভিতর। কোথায় যেন একটা অজানা অচেনা শক্তি ওকে টেনে ধরছে পিছন থেকে। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছুড়ে ফেলে কেন সে ছুটে যেয়ে ওর আদর্শের প্রতিভূকে একজন রক্ত মাংসের বাবা হিসেবে জড়িয়ে ধরতে পারছে না!
অন্তরা সবার সামনে সমাজের সামনে নিজের শিক্ষিত সমাজে প্রথিষ্ঠিত জন্মদাতা বাবাকে অস্বীকার করে অশিক্ষিত ও চাক্ষুস ভাবে বৈশাদৃশ্য আল্লারাখাকে বাবার মর্যাদায় বসিয়েছে। অন্তরা ওর সে বিশ্বাসের জোর থেকে একদম একাকী একান্তে সে সত্যটা প্রদিপকে বলায় প্রদিপ তা অবিশ্বাস করে ওকে ঘৃণা ভরে প্রথ্যাখান করেছে।
অন্যদিকে আজ একাকী একান্তে নিজের জীবনের চরম সত্যকে জানার পরও প্রদিপ কেন পারছে না নিজ জন্মদাতা বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে।
কেন মনে হচ্ছে আল্লারাখাকে ও কেবলই আদর্শ একজন বাবার অবতার হিসেবেই দেখতে চায়। একজন রোল মডেল হিসেবে দেখতে চায়। এর থেকে বেশী কিছু না।
ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট বোঝার জন্য দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে থাকা যায়। চারিদিকে রাশি রাশি খাবার থাকলে মনের জোরে শরীরের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু খাবার অভাবে লাগা ক্ষুধা সহ্য করা যে অসহনীয় যন্ত্রনা।
বস্তিবাসীদের সবকিছু জেনে প্রদিপের ভেতরটা দিকভ্রষ্ঠ হয়েছিল, কিন্তু আজ বাইরের যা কিছু তাও মিথ্যে হয়ে ওর ভেতর বাহির সব সমেত ওর অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
জীবনটা কোথায় শুরূ হয়েছিল সেটা প্রকৃতই ওর অজানা। যেটুকু সত্য বলে জানতো তাও আজ মিথ্যে হয়ে গেল। এত বিশাল পৃথিবীতে কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মত ও একদম একা। চারিদিকে কেবল শুণ্যতা।
দেবালয়ে দেবতাদের বসবাস। ইন্দ্রিয়ের কোন বিড়ম্বনা যাদের নেই। ইন্দ্রিয়ের কোন প্রয়োজন সেখানে অনুভুত হয় না। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের খাচায় বসবাস করে প্রদিপ কি ভাবে তাকে অস্বীকার করবে!

আল্লারাখা সব খুজে পেয়েও নতুন করে শুরূ করার কোন উপায় না পেয়ে এতদিনকার সত্যটা নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে ওর শুরূর সাথেই নিজেকে আরো গভীর ভাবে গেথে নিয়েছে।
সালাম তরফদার নিজের ভেতরটাকে আবিষ্কার করতে পেরে ফিরে এসেছে একদম উৎপত্তির কাছাকাছি। অন্তরা দুখী মানুষের কাছাকাছি দাড়ানোর সুযোগ পেয়ে খুশী হয়েছে। ওর ভাই সাকিবও বিদেশ থেকে ফিরে যোগ দেবে শিগ্রিই।
পলাশ পাশ করে ফেরত এসে ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছে নেওয়াজ গ্রুপ অব ইন্ডাসট্রিজে। উর্মিলা ডাক্তারী পাশ করার পর তারই সাথে পাশ করা একজন ডাক্তার ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে।
সবই চলছে চলবে নিজ গতিতে।

ওদিকে প্রদিপ ঠিকই জ্বলে রইলো। ক্ষিদে পেলে ঠিক মত খাবার খায়। দেরী হলে খাবারের জন্য তাগাদাও দেয়। বাগানের মধ্যে হাটাচলা করে দিন কাটায়। কোন ব্যপারে কোন অভিযোগ করে না কারো কাছে।
চোখে মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। আছে কেবল শুণ্যতা।

অন্যের কষ্টে যারা কষ্ট পায়, অন্যের বেদনায় যারা ব্যাথিত হয়, তারা নিঃসন্দেহে ভাল সহানুভূতিশীল মানুষ। আর যে সমস্ত মানুষ অপরের কষ্ট দুঃখকে নিজের কষ্ট দুঃখ বলে অনুভব করে তারা অতীব সংবেদনশীল ভাল মানুষ। পরের ক্যাটাগরির মানুষের মধ্যে যারা অন্যের কষ্টগুলো লাঘব করার জন্য সাধ্যমত তৎপরতা চালায় তাদের বেলাই শুধু মাত্র ভাল মানুষ কথাটা বোধহয় কম হয়ে যায়। এ ধরনের মানুষেরা ভাল থেকে অনেক উপরের স্তরের। ছোট কাল থেকেই প্রদিপের মধ্যে এ স্বভাবটা স্পষ্ট ছিল।
প্রদিপ নেওয়াজ সে স্তরের একজন মানুষ নিঃসন্দেহে।
মানুষ কথাটা ব্যবহার করলে প্রদিপের বেলায় অর্থটা বোধহয় ভুল হবে। ও তো ছোট একটা ছেলে মাত্র, জীবনের কত টুকুনই পথ ও হেটেছে।
বর্জ্য পদার্থের উপর জন্মানো কোন সুগন্ধি ফুল যা জন্ম থেকেই সকলকে সৌরভ বিলিয়ে নিজেকে ধন্য করে আসছে, হটাৎ করে একদিন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্জ্য পদার্থের গন্ধ যদি তার নাকে এসে লেগে নিজের অস্তিত্তের উপর বিতৃষ্ণা জন্মাই তাহলে সে মন নিয়ে কেমন করে ও আর গন্ধ ছড়াবে আর কেমন করেই বা সে বেচে থাকবে?
অভাবী বা কষ্টে পড়া মানুষদেরকে সাহায্য করার মধ্যে অনেক ধরনের মানসিকতা কাজ করে। তার মধ্যে একটা হল নির্ভেজাল ভালবাসা। আর অন্য গুলোর মধ্যে লোক দেখানোর ব্যাপার থাকে। অভাবী বা কষ্টে পড়া মানুষদের জন্য প্রদিপের যে আজন্ম ভালবাসা সেটা কি কোন ভাবেই ওর জন্ম সুত্রের সাথে জড়িত ছিল?
আর থাকলেই বা কি এসে যায়! কিন্তু প্রদিপ সেটা কেন মেনে নিতে পারছে না?
ছেলের এ অবস্থা দৃষ্টে নাসিম নেওয়াজ ও তার স্ত্রী মরমে আহত হয়ে নির্বাক হয়ে রইলেন।
সেদিন প্রদিপই প্রকৃত অর্থে রেবেকা বেগমের জীবন ফিরিয়ে দিয়ে নাসিম নেওয়াজের পরিবারকে নতুন প্রান দান করেছিল। ও সেদিন ওভাবে ওদের জীবনে না আসলে এতদিন এ সংসারের হাল যে কি হত তা ভাবতেও ওরা চমকে ওঠে। ওদের আরো দুটি ছেলে মেয়ে আছে কিন্তু প্রদিপ সন্তান হিসেবে ওদেরকে যে স্বর্গীয় তৃপ্তি দিয়েছে অন্য দুই সন্তান তা দিতে পারিনি।
-মা রেবেকা বেগম অন্য দুই ছেলে মেয়েকে বাইরে পাঠালেও কোন ক্রমেই প্রদিপকে চোখের আড়াল হতে দেননি। প্রদিপ তার কাছে অন্য সবার থেকে আলাদা কিছু। কিন্তু একি হল এখন! ওত টুকু ছেলে কি ভাবে এ বাস্তবতার বোঝা বহন করবে।
কাঁদতে লাগলেন রেবেকা বেগম।
রক্তের সম্পর্ক আর সমাজ স্বীকৃত সম্পর্ক গুলো সামাজিক ভাবে দৃশ্যমান এবং এ ধরণের সম্পর্কের ব্যপারে একটা দায়িত্বের বন্ধন থাকে। দায়িত্বগুলো সঠিক ভাবে পালনের জন্য পরিবার তথা সমাজ সব সময়ই তাড়া দেয়। সেটা পালন না করলে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যার্থ হওয়ার দায়ে সমাজ অপরাধীকে জবাবদিহিতারও সম্মুখীন করে থাকে। রক্ত আর সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কের বিষয়গুলো পার্থিবতার সাথে সম্পৃক্ত।
কিন্তু রক্ত আর সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কের গণ্ডির বাইরের সম্পর্কগুলো একদম অন্যরকম। যার অস্তিত্ব শুধু অনুভবে, মনের গণ্ডির অনেক উপরের বিষয় সেগুলো। কোন তথ্য প্রমানের ধার ধারে না এ ধরনের সম্পর্ক। এগুলো আত্মিক সম্পর্ক।
রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তা প্রমাণও করা যায়। আর সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কগুলো সামাজিক নিয়ম মেনেই পরিচালিত হয়। এ ধরণের সম্পর্কগুলো সবসময় মনের গণ্ডির চার দেয়ালে ঘুরপাক খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।
মন প্রমানে বিশ্বাসী এছাড়া মন সমাজের অনুশাসনেও বিশ্বাসী। রক্ত বা সমাজ স্বীকৃত সম্পর্ক গুলো মনের গন্ডিতে জন্ম নিলেও সেগুলো আত্মিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
কিন্তু সমস্ত প্রমাণ বা সামাজিক অনুশাসনের বাইরে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেটা আত্মার সম্পর্ক, রক্ত বা সমাজ ইত্যাদি পার্থিব সব কিছুরই ঊর্ধ্বে যার অবস্থান।
আত্মিক সম্পর্কিত কারো খারাপ কিছু হলে হৃদয়টা বিদীর্ণ হয়।

প্রদিপের সাথে রেবেকা আর নাসিম নেওয়াজের সম্পর্কটা সে পর্যায়ে পড়ে।

সেই ছোট বয়স থেকেই প্রদিপ যে ভাবে ওর অন্য দুই ভাই বোনকে আগলে রেখে ওদেরকে বড় হতে সহায়তা করেছে আর সর্বোপরি নেওয়াজ পরিবারকে বিভিন্ন দুঃসময়ে যে ভাবে রক্ষা করেছে তার জন্য বাবা মা হয়েও ওরা প্রদিপের কাছে ঋণী।
-কত টুকুই বা বয়স ওর, পৃথিবীর কতটুকুই বা দেখেছে ও, খোদা ওই নিস্পাপ সন্তানকে কেন এই বাস্তবতার সন্মুখিন করে ওকে এই কষ্টটা দিচ্ছে? বলতে পার রেবেকা? এটা শুধু তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য? এ সবের প্রকৃত অর্থ কি?
কথা বলতে বলতে গলাটা ধরে আসলো নাসিম নেওয়াজের।
-একি তাঁর খেলা! তবে কিসের জন্য এ খেলা! তাঁর এ খেলার চরিত্রগুলো যদি কার্টুনের মত হত, যেখানে কোন জ্বালা যন্ত্রণা নেই তাহলে কোন কথা ছিল না। কিন্তু এ তো সেরকম নয়। মানুষতো কার্টুন চরিত্র নয়, তারা রক্ত মাংসের মানুষ, তাঁর রচিত খেলা খেলতে যেয়ে তাদের কষ্ট হয়, তাদের অন্তর বিদীর্ণ হয়। প্রদিপ ছেলে মানুষ ওর এত কষ্ট কেন হবে!
কাঁদতে লাগলেন রেবেকা বেগম।
-জীবন থেকে কি পেল আল্লারাখা? কি বা পেল ওর স্ত্রী দোলন? বস্তিবাসীদের কেবল শরীরে বেচে থাকার জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি?
-কি করবে এখন নাসিম নেওয়াজ ও তার স্ত্রী রেবেকা? কি ভাবে চলবে প্রদিপের জীবন? মানুষ কত অসহায় মহা পরাক্রমশালী বিধাতার এ পৃথিবীতে?
-জীবনের প্রকৃত অর্থ বা উদ্দেশ্য কি?
কথাটা চিন্তা করে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নাসিম নেওয়াজ।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.