অসহায় মানুষ -২০ 

 

প্রদিপ আর আল্লারাখার সম্পর্কের ব্যাপারে কাজলের কাছ থেকে সব শুনে নির্বাক হয়ে রইলেন নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী।
সেদিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেদে উঠলো কাজল।
-স্যার আমি মুর্খ্য সুখ্য মানুষ, এত সবের কোন অর্থ আমি বুঝি না।
-ঠিক আছে তুই শান্ত হ। সত্য তুসে চাপা আগুনের মত একদিন না একদিন সত্যটা জ্বলে উঠবেই।
নাসিম নেওয়াজের কথায় চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল কাজল।
নির্বাক হয়ে বসে রইলেন নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী।

-অন্তরা আল্লারাখার মেয়ে নয়। প্রদিপের মায়ের কবরে আল্লারাখার কান্নাকাটি এর থেকে কিছু মিলাতে পার রেবেকা।
পাথরের মত বসে রইলেন রেবেকা বেগম। একটা কথাও সরলো না তার মুখ থেকে। স্বামীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালেন তার চোখের দিকে। দুচোখ বয়ে কেবল ঝরতে লাগলো অশ্রু বন্যা।
স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলেন নাসিম নেওয়াজ তাকে শান্তনা দেয়ার জন্য।
-হে রেবেকা, এই দিনটার জন্যইতো আমরা অপেক্ষা করে আছি কত বছর ধরে। তোমার সে কথাটা আমি নতুন করে বলি – সত্য যতই রূঢ় হোক না কেন তা সব সময় সুন্দর। চল সেটা আমরা নতুন করে বিশ্বাস করে সব কিছু মেনে নিই।
চোখ মুছলেন রেবেকা বেগম।
-না, আমার চোখের পানির কারণ সেটা নয়। তাছাড়া ও নিজে কোন খোজ না পেলেও প্রদিপের বিয়ের আগেই ওর জীবনের অজানা সত্যটা ওকে বলার পরিকল্পনাতো আমরা আগেই নিয়ে রেখেছিলাম।
-আমি মা, আমার গর্ভে থেকে দু’টো সন্তানের জন্ম হয়েছে, প্রদিপ আমার গর্ভজাত নয় কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলছি প্রদিপ আমার শরীরের অংশ না হলেও ওর স্থান আমার অন্তর জুড়ে তায় ওকে হারানোর কোন ভয় আমার নেই। যা কিছুর শারীরিক অস্তিত্ব আছে তা একদিন না একদিন হারিয়ে যায় কিন্তু প্রদিপের অস্তিত্ব আমার সাথে শারীরিক নয় শুধু ভালবাসার তায় তা হারানোর কোন ভয় নেই।
-আমি কাদছি আল্লারাখার কষ্টের কথা চিন্তা করে। সে প্রথম থেকেই চিনতে পেরেছে ওর ছেলেকে কিন্তু কোন এক অপরাধবোধ ওকে পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য করেছে।
স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলেন রেবেকা বেগম।
-বড় হতভাগা ওই আল্লারাখা।

একটু বাদেই প্রদিপ আসলো।
-বাবা ভাবছি দুএকদিনের মধ্যে আমরা সবাই যাব ওদের বাড়ী। সবার সামনে অন্তরার বাবাকে আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে অন্তরার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবো যে কি ভাবে গুণীজন আর মুরব্বিদের কদর করতে হয়।
ছেলের কথার কেউ কোন জবাব দিল না।
প্রদিপ নিজের অজানা প্রশ্নের ফাদে এমন ভাবে আটকে ছিল যে ওর বাবা মায়ের মুখের উপর প্রতিভাত কষ্টের রেখাগুলো ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল।
প্রদিপের কষ্টটা -ওর গল্পের আদর্শ চরিত্র দু’টো গল্প থেকে বের হয়ে আসতে চায়ছে। অন্তরা আর আল্লারাখাকে সে অগনিত মানুসের সামনে রোল মডেল হিসাবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু ওদের কাউকেই আর সে আদর্শ চরিত্রের সাথে মানানসই না বলে মনে হচ্ছে ওর কাছে।
লেখকরা তাদের কল্পনায় আদর্শ চরিত্র অংকন করে নিপুন কুশীলবদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে মানুষের জন্য রোল মডেল তৈরী করে সকলের মধ্যে সে আদর্শ বাচিয়ে রাখার উদ্দীপনা যোগায়। কিন্তু এক্ষেত্রে রক্ত মাংসের আসল মানুষকে প্রদিপ ওর চিন্তায় গড়া গল্পের চরিত্রের সাথে মিলাতে চাইছে।
বাবা মায়ের নির্লিপ্ততা দেখে এতোক্ষনে একটু সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলো প্রদিপ।
যে কোন কাজে ছেলের আন্তরিকতার ব্যপারে ওয়াকেবহাল তারা। প্রদিপ যখন কোন কাজ করে তখন সে কাজে শুধু মেধা নয় অন্তরটাও উজাড় করে দেয়। তায় সত্যটা ওর জানা দরকার।
ভাবলো ওরা দুজনাই।
-ওদেরকে তুই পাবি কোথায় বাবা, ওরা বোধহয় ইতিমধ্যেই ওবাড়ী ছেড়ে চলে গেছে।
মায়ের কথায় থমকে গেল প্রদিপ।
-চলে গেছে মানে?
-অন্তরা আল্লারাখাকে সাথে নিয়ে ওদের পৈত্রিক ভিটেয় ফিরে যাবে।
-তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না মা?
-ওদের পুরনো জমিদার বাড়ী। ওর বাবা দেশের বাইরে থাকেন। তিনিও ফেরত আসছেন সব ব্যবসা গুটিয়ে। বাকি জীবনটা পৈত্রিক ভিটেই কাটাবে বলে। জমিদার বাড়ীতে একটা হাসপাতাল বানাচ্ছে ওরা।
-সে যা বানায় বানাক। তবে ওর বাবা সম্পর্কে যা বললে?
-ঠিকই বলছে তোমার মা।
দরদ ভরা কিন্তু ভাবাবেগহীন কণ্ঠ নাসিম নেওয়াজের।
-বাবা কি বলছো তোমরা, আমার সন্দেহ হওয়াই আমি অন্তরার কলেজে গিয়ে ওর সবগুলো সার্টিফিকেট দেখেছি। আল্লারাখাই ওর বাবা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
-যা কিছু দেখা যায় তার সব কিছু সব সময় সত্য হয়না প্রদিপ। দেখা বা শোনা সত্যের পিছনে অনেক আসল সত্য চাপা থাকে বাবা। আর সব সত্য কি চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখা যায় বাবা!
-তুমি কি বলতে চায়ছো বাবা!
-একবার ভাবতো সার্টিফিকেটে অন্তরা ওর বাবার জায়গায় যার নাম লিখেছে, বাস্তবে সবার সামনে যাকে বাবা বলে স্বীকার করছে প্রতিনিয়ত, অন্তরা সে সত্য তোর কাছে অস্বীকার করলো কেন?
কোন জবাব দিল না প্রদিপ।
-ঠিক আছে, অন্তরা দুনিয়ার কাছে আল্লারাখাকে বাবা বলে স্বীকার করলেও যদি তোর কাছে একান্তে আল্লারাখা ওর বাবা নয় বলে থাকে তাতে কি কিছু প্রমান হয়?
-তাতে আর যাই প্রমান হোক না কেন বাবা, তা দিয়ে কি এত বড় একটা সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমান করা যায়!
দ্বিধাহীন জবাব প্রদিপের।
-ও সত্যটাকে মিথ্যা প্রমান করার ভার তুই নিজ কাধে কেন তুলে নিতে চাস। আল্লারাখা অন্তরার প্রকৃত বাবা হোক আর নাই হোক তাতে তোর কি আসে যাই?
বাবার এ প্রশ্নে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো প্রদিপ।
-বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেচিস কখনো?
-অমন সাধারণ একটা মানুষের অন্তরার মত অসাধারণ একটা মেয়ে, এটা ভাবতে যে মনটা আমার ভরে যায় বাবা। অন্তরা আমার চোখে অনন্যা। কোন মিথ্যা ছল চাতুরী যে ওকে মানায় না।
গভীর আন্তরিকতায় ভরা প্রদিপের কণ্ঠস্বর।
-তুই ঠিকই বলেচিস প্রদিপ, অন্তরা একটা অসধারণ মেয়ে আর কোন ছল চাতুরী ওর করার কথা নয়।
-তাহলে ও এমন করলো কেন বাবা?
-কোন ছল চাতুরী অন্তরা করিনি। কারণ আল্লারাখা ওর জন্মদাতা বাবা নয়।
-কি বলছো তুমি বাবা!
-ঠিকই বলছি আমি। আর জেনে রাখ খোকা, যা দেখা যায় বা কাগজে লেখা থাকে সব সময় তা সত্য হয়না।
-তুমি বইয়ের ভাষা ব্যবহার করছো বাবা কিন্তু আমি যা বলছি তা বাস্তব।
-বাস্তববাদী লেখকরা তাদের বইতে যে ভাব বা ভাষা ব্যবহার করে সেগুলো মানুষের জীবন থেকেই নেয়া। ওরা কেবল একটু সাহিত্যের ছোঁয়া লাগিয়ে সবার কাছে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আসলে তুই অকারণে অন্তরাকে তোর মানবিকতার প্রজেক্টের রোল মডেল বানিয়ে ওর রক্ত মাংসের অস্তিত্বকে ভুলে যাচ্ছিস। আমি তোর বাবা তায় বাস্তবতা তোর থেকে আমি ঢের বেশী দেখেছি।
-তুমি কি তার কোন প্রমান পেয়েছ?
-সব কিছুর কি প্রমান হয়? ছেলেকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন নাসিম নেওয়াজ।
-সব কিছুর হয় কিনা জানিনা, তবে কে কার মা বাবা তার তো প্রমান অবশ্যই থাকবে। এই যেমন ধর তোমরা আমার মা বাবা।

প্রদিপের কথায় নাসিম নেওয়াজ তাকালেন স্ত্রীর চোখের দিকে। ভাবলেন কিছু একটা। প্রদিপকে আদর করে কাছে টানলেন।
– প্রদিপ শোন, তুই বড় হয়েচিস তায় নিশ্চয় সহজেই বুঝবি তোর প্রতি আমাদের ভালবাসা স্নেহ চির অটুট। জীবনের এই পর্যায়ে এসে কোন অপ্রিয় সত্যই আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কোন চিড় ধরাতে পারবে না সেটা আমরা জানি।
বাবার এ ধরণের মন্তব্যে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল প্রদিপ।
স্বামীর সাথে ক্ষনেকের জন্য দৃষ্টি বিনিময় করে ছেলের পাশে গেলেন রেবেকা বেগম। প্রদিপের একটা হাত অতি আদরে নিজের হাতের ভিতর নিলেন।
– প্রদিপ, সোনা সব প্রমান থাকা সত্বেও যদি বলি আমি তোর জন্মদাতা বাবা না, তোর মা তোকে পেটে ধরেনি তাহলে তুই বিশ্বাস করবিতো।
-বাবা! আহত কণ্ঠ প্রদিপের।
-মা, পাগল হয়ে গেছে বাবা। চিৎকার করে উঠলো প্রদিপ।

রেবেকা বেগম আরো জোরে ছেলের হাতটা চেপে ধরলেন। মায়ের সে মুখে না বলা ভাষা পরিস্কার বুঝল প্রদিপ।

হতভম্ভ হয়ে গেল প্রদিপ। জীবনটা যেন থেমে গেল। পায়ের সব জোর হারিয়ে পাশে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো।
রেবেকা বেগম স্বস্নেহে ছেলের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আর দুচোখ বয়ে কেবল অশ্রু ঝরতে লাগলো।
নাসিম নেওয়াজ এসে ছেলের অন্য পাশে বসলেন।
বেশ কিছুক্ষন ধরে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কাদলো প্রদিপ।

জীবনে অনেক বার ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরেছে, ব্যথায় বুকটা মোচড় দিয়েছে। কিন্তু তার সব ছিল অন্য মানুষের কষ্টে। এই প্রথম নিজের কষ্টে বুকের মধ্যে ব্যথা করছে।
আজ এ কি সব হচ্ছে ওর সাথে! এ ব্যথা যে অসহনীয়। এ যন্ত্রনার রূপ যে ভিন্ন। মনে হচ্ছে দম বন্দ হয়ে এখনই মরে যাবে ও।
বিচারকের চেয়ারে বসে তথ্য প্রমান সাপেক্ষে কাউকে মৃত্যু দন্ড দিয়ে কষ্টে বিচারক তার বিচার লেখা পেনটা ভেঙ্গে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে মানবতার কর্মীরা বিচারককে দেবতার আসনে বসিয়ে তাঁর স্তুতি করে। তাতে বিচারকের দুচোক বয়ে মানবতা প্রেমের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পারে। তাতে সন্দেও নেই। অপরাধী যদি বিচারকের নিজ সন্তান হয় বা বিচারক নিজেই যদি ওই আসামী হয় তখন পুরো বিষয়টি অন্য মাত্রা পায়।
-মা আমাকে একটু বাতাস কর, মনে হচ্ছে দমটা এখনই বন্দ হয়ে যাবে। যন্ত্রনায় জ্ঞান হারালো প্রদিপ।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.