অসহায় মানুস- ১৮ 

 

ড্রাইভার কাজলকে ডেকে পাঠালেন নাসিম নেওয়াজ। কাজল আজও আল্লারাখার সাথে বাগানে ছিল অনেক্ষন। পূর্বেও অনেকবার বাগানে পায়চারী করার সময় ও সঙ্গ দিয়েছে আল্লারাখাকে।
কাজল নাসিম নেওয়াজের অনেক পুরনো এবং বিশ্বস্থ কর্মচারী। ঘটনা সম্পর্কে যৎসামান্য বর্ণনা করে তিনি আল্লারাখা সম্পর্কে তাদের না জানা প্রসঙ্গে ওকে জিজ্ঞেস করলেন।
-স্যার এতোক্ষণে সব বুঝছি, অপরাধী আমি। আমাকে শাস্তি দেন।
হাউ মাউ করে কেদে উঠলো কাজল।

প্রদিপ সম্পর্কে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বেও একবার এমনিভাবে কেদেছিল কাজল।

প্রদিপ তখন ক্লাস টেনে পড়ে। গরমের ছুটি।
চিরকালের অভ্যাস বসতঃ প্রদিপ বাড়ীতে থাকলে বাড়ীর বিভিন্ন কাজের মানুষ, ড্রাইভার বা বাবার কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে দিন কাটে ওর।
পুরনো ড্রাইভার কাজল মিঞা। প্রদিপের জন্মের আগ থেকেই এ বাড়ীতে ও। বয়স প্রায় ষাটের কোটায়। পরিবার নিয়ে নেওয়াজ বাড়ীর সীমানার ভিতর একটা কোয়াটারে বসবাস করে।
আরো প্রায় সাত আটটা কোয়াটার আছে ওখানে। কোন কাজ না থাকলে প্রদিপ সবার কোয়াটারে বেড়াতে যায়।
কাজল মিঞার বাড়ীতে গেল প্রদিপ একদিন বিকেল বেলা। কাজলের স্ত্রী জানালো কাজল ঘরে নেই বোধহয় হাটতে বেরিয়েছে বাগানে, এসে পড়বে এখনই। প্রদিপকে বসতে বললো ওর স্ত্রী।
প্রদিপ একাকী বসে কাজলের অপেক্ষায়। পুরনো একটা এ্যলবাম উল্টাতে উল্টাতে একটা ছবির দিকে নজর আটকে গেল ওর।
অল্প বয়সী একজন মহিলা মাথায় ব্যান্ডেজ কোলে দুধের বাচ্চা। তাকে ধরে পাশে দাড়িয়ে যুবক বয়সের ড্রাইভার কাজল। ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজলের এই বাড়ীর জানালাই বলে মনে হচ্ছে।
কৌতুহলী হয়ে উঠলো প্রদিপ।
-কাজল চাচার সাথে কার ছবি এটা চাচি।
-কই দেখি?
চা আর বিস্কুট নামিয়ে রাখতে রাখতে কাজলের স্ত্রী ছবিটা হাতে নিল।
-ছবিটা আমার বিয়ের আগের। কাজলকে আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন। কিন্তু পরিস্কার কোন জবাব দেয়নি।
কাজল আসতে দেরী হওয়াই সেদিন বিদায় নিয়ে চলে আসলো প্রদিপ। কিন্তু কৌতুহলটা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারলো না মন থেকে।
পরদিন দেখা হলে কথার ছলে ছবিটার ব্যপারে কাজলকে জিজ্ঞেস করলো প্রদিপ।
বউয়ের কাছ থেকে আগেই জানতো ছবিটার ব্যপারে প্রদিপের কৌতুহলের কথা তায় জবাবটা ঠিক করে রেখেছিল কাজল।
-দাদাবাবু, ও আমার দূর সম্পর্কের এক বোন।
-তোমার সব আত্মীয় স্বজনদের ব্যপারে আমাকে কম বেশী বলেছ তুমি। কিন্তু ওই বোনটার ব্যপারেতো কখনোতো কিছু বলনি?
-বললামতো দূর সম্পর্কীয়।
আরো কিছু জিজ্ঞেস করতো প্রদিপ। কিন্তু তখনই রেবেকা বেগম কাজলকে তাড়াতাড়ি ডাকছে বলে জানালো বাড়ীর কাজের ছেলেটা। কাজলও নিজের থেকে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
ওকে থামিয়ে প্রদিপ ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করলো কাজলকে আবার।
কারণ প্রদিপ বুঝেছিল উত্তরটা এড়ানোর কোন প্রসঙ্গ খুজছে কাজল।
আবার ডাক আসলো রোকেয়া বেগমের কাছ থেকে।
-তোমার বাবা জানেন ব্যপারটা, তাকে বলেছিলাম। ওনাকে জিজ্ঞেস করো।
কোন রকমে নাছোড়বান্দা প্রদিপকে জবাবটা দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো কাজল।
কাজল কেমন যেন লুকোচুরীর আশ্রয় নিচ্ছে মনে হওয়াই আরো কৌতুহলী হয়ে উঠলো প্রদিপ।
প্রদিপ ওই দিনই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো ছবিটা সম্পর্কে।
ছবিটা কাজলের ঘর থেকে প্রদিপ দেখেছে জানতে পেরে নাসিম নেওয়াজ মনে মনে ভিষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কাজলের উপর।
যাহোক, তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলের কৌতুহল মেটানোর চেষ্টা করলেন।
-রাজধানী বস্তি থেকে কয়েকদিন বয়সের একটা ছেলে সহ ওই মহিলাকে এনেছিল কাজল। তখন তোমার মা ভিষণ অসুস্থ তোমাকে জন্ম দিয়ে। তায়তো আমিও পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। তায় আর খোজ রাখতে পারিনি। মহিলাটি পরদিনই মারা যায়।

প্রদিপের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে বাবা বড় কোন কাহিনীকে খুব অল্প কথায় শেষ করে দিলেন। জটিল অংকের অতি সরল সমাধান।
বাবার অতি সংক্ষিপ্ত জবাবে প্রদিপ বাবার চোখের দিকে নিরলিপ্তে তাকিয়ে থাকা দেখে তার উত্তরে ছেলের অসন্তুষ্টির ব্যপারটি বুঝলেন নাসিম নেওয়াজ।
-প্রদিপ এ নিয়ে তুমি এত কৌতুহলী হয়ে উঠলে কেন? তখন তোমার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ডাক্তারতো সব আসা ছেড়েই দিয়েছিল। পরে তোমাকে কোলে পেয়েই তোমার মা বাচার শক্তি ফিরে পেয়েছিল। তোমার ছোয়াই যে সেদিন সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে বেচে উঠেছিল তোমার মা।
নাসিম নেওয়াজ একবার ভেবেছিলেন কাজলের এ্যালবাম থেকে ছবিটা সরিয়ে ফেলবে। আবার ভাবলেন কৌতুলী প্রদিপ পরে আবার কখনো ছবিটা খোজ করতে যেয়ে যদি তা জানতে পারে। তবে তাতে ওর মনে আরো অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে।
রেবেকা বেগমকে পরে তিনি বলেছিলেন কথাটা। প্রায় বিশ বছর আগেকার সে স্মৃতি রেবেকা বেগমের বুক কাপিয়ে দিল।

এ নিয়ে আলোচনা করলেন স্বামী স্ত্রী দুজনে স্ববিস্তারে। ঠিক করলেন আর একটু বড় হলে সময় সুযোগ মত প্রদিপকে বিষয়টা তারা নিশ্চয়ই নিজেরাই জানাবে। পাছে অন্য ভাবে সব ও জানতে পারে!
আর তখন যদি প্রদিপ ওর মায়ের ছবিটা দেখতে চায়!
কথাটা উঠতেই স্বামী স্ত্রী দুজনেই আবার চমকে উঠলো।
কাজলকে ডাকলো তখনি। ছবি সম্পর্কে নাসিম নেওয়াজ ছেলেকে যা জানিয়েছে তা জানালো ওকে। কাজলকে আরো বললো ছবিটা যেখানে যে ভাবে আছে ও ভাবেই রাখতে।

এত বছর পর একই প্রসঙ্গ উঠে আসায় কাজল কাদতে লাগলো।
-তোর কান্না থামা কাজল। তোর উপর অগাধ বিশ্বাস আমার তাড়াতাড়ি খুলে বল সবকিছু।
চোখ মুছলো কাজল।
এ বাড়ীতে আল্লারাখা প্রথম যেদিন আসে সেদিন ট্রেন ষ্টেশান থেকে কাজলই ওকে নিয়ে এসেছিল।

আল্লারাখা ষ্টেশানে নেমে নাসিম নেওয়াজের বাড়ীর ঠিকানা কাউকে জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবছে তখনই দেখা হলো কাজলের সাথে।
গাড়ীতে কিছু কাজ করানোর জন্য ভোরে ষ্টেশান রোডে একটা গ্যারেজে গাড়ীটা দিয়ে পাশের একটা পানের দোকানের সামনে দাড়িয়ে পান চিবাচ্ছিল কাজল।
ষ্টেশান থেকে বেরিয়ে আসা আল্লারাখাকে দেখেই চিনলো ও।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সালাম করলো।
– প্রদিপকে দেখতে এলাম, খবর না দিয়েই চলে এলাম।
-তাতে কি হয়েছে। নেওয়াজ সাহেব খুব খুশি হবেন।
সদালাপী কাজলকে পেয়ে ভালোই হলো। ওই জানালো এখান থেকে প্রায় পাচ ছয় কিঃ মিঃ পথ, গাড়ীটা কিছুক্ষনের মধ্যেই গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গেলেই তাকে গাড়ীতে করেই নিয়ে যাবে।
গাড়ীটা বেরূতে একটু সময় লাগবে তায় কিছু খাওয়া আর বসার জন্য পাশে একটা রেষ্টুরেন্টে গেল ওরা।
প্রদিপকে নিয়েই কথা শুরূ হলো। প্রদিপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ কাজল। ওর মতে প্রদিপের মত একটা মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
কথায় কথায় প্রদিপের বস্তিতে কাজ করার প্রসঙ্গ উঠলো।
-স্যার, গরীবের প্রতি ভালবাসা প্রদিপ দাদাবাবুর রক্তে।
প্রদিপের গল্প একের পর এক করতে লাগলো কাজল। ওদের কারখানার শ্রমিক থেকে শুরূ করে বাড়ীতে বসবাসরত যত কর্মচারী সবার সাথেই প্রদিপের ভালবাসার ঘটনা বলতে লাগলো এক এক করে।
-সাহেবের আরো দুটো ছেলে মেয়ে আছে কই তাদের শরীলেতো অত দরদ নেই। সবই রক্তের টান স্যার রক্তই ওনারে টানে গরীবের ল্যাইগ্যা।
-ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।
-না স্যার থাক ওসব কথা।
কাজল যেন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায়লো।
-থাকবে কেন বলনা। ওই বস্তিতে আমারও যাতায়াত অনেক বছরের। বস্তির গরীব মানুষেরা ওকে আপন জন মনে করে, সেটা জানি আমি।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো কাজল। তাকালো গভীর ভাবে আল্লারাখার দিকে।

 

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.