অসহায় মানুষ -১৭ 

 

বেশ সকালেই আল্লারাখা আসলো নাসিম নেওয়াজের বাড়ীতে।
নাসিম নেওয়াজ বাইরে ছিলেন। ভেতর বাড়ীতে না ঢুকে আল্লারাখা সামনে বসার কক্ষে বসে বইলো বিষণ্ণ বদনে।
সকালে হাটাহাটি সেরে ফিরতেই দেখা হলো নাসিম নেওয়াজের সাথে। অন্য সময়ের মত আল্লারাখাকে হাসিখুশী না দেখে সন্দেহ হলো তার। কিন্তু তার সে ভাবনার কোন কিছু বুঝতে না দিয়ে হাসি মুখেই আল্লারাখাকে স্বাগত জানালেন।
-কি খুশীর বিষয়, কেমন আছেন আপনি?
-ভাল।
খুব অবসন্ন কণ্ঠ আল্লারাখার।
-অন্তরা কেমন আছে? কিছুটা উদ্বিগ্নতার সুর নাসিম নেওয়াজের কণ্ঠে।

-না না, কারো কিছু হয়নি ব্যস্ত হবেন না।
কথা বলতে বলতে নাসিম নেওয়াজের বসলেন তার পাশে।
রেবেকা বেগম আসলো একটু বাদে।
ততোক্ষনে বেশ স্বাভাবিক কথাবার্তা শুরূ হলো।
একটু অবাক হলেও নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রীর আচরণ বা কথাবার্তায় কোন কিছুই প্রকাশিত হলো না। প্রদিপকে ধারে কাছে না দেখে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবছিল আল্লারাখা।
কুশল বিনিময় শেষে রেবেকা বেগম আসছি বলে ভিতরে ঢুকে ট্রেতে করে চা বিস্কিট নিয়ে সামনের টি টেবিলে নামিয়ে রেখে হাস্য বদনে পাশে বসলেন।
-অন্তরাকে নিয়ে কি ভাবছেন? আল্লারাখাকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে রেবেকা বেগমের প্রশ্নে একটু হতচকিত হল আল্লারাখা।
-কই নাত কিছু না। কেন বলুন তো?
একটু যেন চমকে উঠে উত্তর দিল আল্লারাখা।
নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী নীরবে দৃষ্টি বিনিময় করলো।
-না, মানে ওর ভবিষ্যত নিয়ে।
ইতস্তত কণ্ঠ রেবেকা বেগমের।
ততোক্ষনে নিজেকে গুছিয়ে নিল আল্লারাখা।
-মুলত অন্তরার ইচ্ছেতে ওদের নিজের বাড়ীতে একটা হাসপাতাল তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। অনেকদিন ধরে পড়েই ছিল বাড়ীটা কিন্তু কিছুতেই ভাড়া দিতে দিল না। যাহোক, এখন জায়গাটাও ব্যবহার হবে আর মানুষেরও কল্লান হবে।
-সেত খুব ভাল কথা। তা কবে নাগাত ওটা শুরু হবে।
– যে ভাবে কাজ চলছে তাতে করে বছর খানেকের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
হাসে মুখেই রেবেকা বেগমের কথার উত্তর দিল আল্লারাখা।
-সে সব ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ের বয়স বাড়ছে না। বিয়ে টিয়ে দিতে হবেতো নাকি?
বলা যায় ততোক্ষণে বেশ হালকা মেজাজেই কথা বলছিলো সবাই। তাই প্রসঙ্গটা খোলামেলা করে বললেন বেবেকা বেগম।
প্রদিপ আর অন্তরার মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার কথা উল্লেখ করে নিজের ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন রেবেকা বেগম।
-না, অসম্ভব তা কি করে হয়!
এবার রীতিমত চমকে উঠে জবাব দিল আল্লারাখা।
আল্লারাখার ওরকম আচরনে অবাক এবং অপ্রস্তুত হলো নাসিম নেওয়াজ এবং তার স্ত্রী।
-কেন সম্ভব না?
প্রশ্ন করলেন নাসিম নেওয়াজ।
-না না, অন্য কিছু নয়। আপনাদের মত উচু তলার মানুষের ঘরে বিয়ে হওয়া যে ওর ভাগ্যের ব্যপার।
তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী।
-ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে, ওদের পছন্দ অপছন্দের একটা ব্যপার আছে না।
-ও এই কথা।
স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন নাসিম নেওয়াজ।
-আরে ওদের মতামতইতো মুল বিষয়। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।
-স্যার, গাড়ী রেডি।
ড্রাইভারের কথায় ফিরে তাকালেন নাসিম নেওয়াজ।

আজও আসার পর আল্লারাখা বাগানে ঘুরতে গিয়েছিল। কাজল ছিল সাথে সেকথা জানেন তিনি। কাজলই ফোন করে জানিয়েছিল।
এখানে আসলেই বাগানটা ঘুরে দেখতে যায় আল্লারাখা। সেকথা জানে ওরা। বাগান দেখতে যাওয়া আল্লারাখার একটা বিশেষ শখ হিসেবে গন্য করে নাসিম নেওয়াজ এবং তার স্ত্রী। তায় ব্যপারটা প্রথম থেকেই সহজ ভাবে নিয়েছেন ওরা। প্রথম প্রথম দু একবার নাসিম নেওয়াজ নিজে ওকে সাথে নিয়ে ঘুরেছেন বাগানে। ঘুরার ফাকে নানা কথায় আল্লারাখা নেওয়াজ সাহেবের কাজ থাকলে তিনি যেতে পারেন বলে ঈঙ্গিত দিলে তিনি বুঝতেন যে আল্লারাখা বোধহয় একা একাই ঘুরতে ভালবাসে। তায় কোন কোন দিন ওকে একা রেখে নাসিম নেওয়াজ চলে আসতেন।
কোন দিন নাসিম নেওয়াজ বাসায় না থাকলে বা কোন কাজে ব্যস্ত থাকলে তাকে বিরক্ত না করে আল্লারাখা একাকীই বাগানে ঘুরতো। কাজল সাথে থাকলে বিনয়তার সাথে ওকেও সময় নষ্ট না করে চলে যেতে বলতো সেটাও জানে ওরা।
আল্লারাখার এ অভ্যাসটা নিয়ে নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী মাঝে মধ্যে আলোচনা করলেও মেহমান যেহেতু খুশী হয় একাকী ঘুরে তায় ব্যপারটা নিয়ে তেমন গুরূত্ব সহকারে আলোচনা করেনি কখনো।
আল্লারাখা যেদিন একাকী অনেকক্ষন ধরে বাগানে থাকতো সেদিন ফিরে আসার পর একটু অন্যমনষ্ক দেখাতো তাকে।
কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করলে আল্লারাখা জোর করেই স্বাভাবিক হতে চায়তো।
আজ আসার পরও আল্লারাখা সোজা বাগানে গিয়েছিল। কিন্তু আজ অন্য দিনকার থেকে আল্লারাখাকে আরো বেশী চিন্তিত আর বিষন্ন মনে হলো নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগমের কাছে।
বাইরে কাজ ছিল কিন্তু আল্লারাখা আসায় আজ আর বের হবে না বলে নাসিম নেওয়াজ জানালেন ড্রাইভারকে।

শরীরটা আজ ভাল নেই সে অযুহাতে সেদিন বেশীক্ষন অপেক্ষা করলো না আল্লারাখা।
শরীর ভাল না থাকলে এতটা পথ কেনই বা এল আবার তেমন কোন কিছু না বলে হুট করে চলে যাওয়াটা কেমন অস্বাভাবিক লাগলো নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রীর কাছে।
বিশেষ করে প্রদিপের সাথে অন্তরার বিয়ের প্রস্তাবে আল্লারাখার ওরকম ভাবে আপত্তির ব্যপারটা ভাবিয়ে তুললো ওদের দুজনকেই।
আল্লারাখাকে বিদায় দিয়ে নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগম সে কথায় আলাপ করছিলেন।

প্রদিপ এসে বসলো।
গত কয়েকদিন থেকে ছেলেকেও কেমন যেন অন্যমনষ্ক আর বিরক্ত দেখাচ্ছে। একটা কিছু যে ওকে তাড়া করছে তা বুঝেছেন ওর বাবা মা দুজনই।
– আল্লারাখা এসেছিল।
মায়ের কাছ থেকে আল্লারাখার কথা শুনে উৎসাহী হয়ে উঠলো প্রদিপ।
-কোথায় তিনি!
-চলে গেল এইমাত্র। মনে হল শরীরটা বোধহয় খারাপ একটু।
-তোমরা যেতে দিলে কেন তাকে এ শরীরে।
-হটাৎ করেই যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে একরকম জোর করেই বেরিয়ে গেল।
প্রদিপ তাকিয়ে দেখল মায়ের মুখের দিকে। যেন আল্লারাখার শারিরীক অবস্থা আচ করার চেষ্টা করলো ও।
-জান বাবা, তোমাকে আমি যতটুকু সম্মান করি ওনাকে তার থেকে একটুও কম করিনা।
প্রদিপ আল্লারাখাকে পছন্দ করে সম্মান করে তা জানে নাসিম নেওয়াজ এবং রেবেকা বেগম দুজনেই। ছেলের এহেন আচরনে খুশী তারা। কিন্তু তা এত স্পষ্ট করে বলার কি প্রয়োজন তা ঠিক বুঝলেন না ওরা কেউই।
-ওর মত একজন নিবেদিত প্রাণ বাবা পেয়ে অন্তরা কত ভাগ্যবতী তায় না বাবা?
-তাতো বটেই।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন নাসিম নেওয়াজ।
-সৎ মানুষ, গায়ে খেটে অত সব সম্পত্তি বানিয়েছেন, মেয়েকে মানুষ করেছেন। ঠিক যেন গল্পের কোন আদর্শ বাবার চরিত্র।
তেমনি ভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে ওর আপাতঃ অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলো শুনছে ওরা দুজন।
-সবাইতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহন করে না। তিনি তার মেধা দিয়ে আর শারিরীক পরিশ্রমের মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন সবকিছু। তায় তার পোশাক পরিচ্ছদ কথাবার্তা বা শরীরে যদি তা প্রতিভাত হয়ে ওঠে আমার কাছে তার মর্যাদা কোন অংশে কমে না বরং বাড়ে।
-তোর কথা সব ঠিক আছে, তবে তুই এসব কেন বলচিস?
বাবার প্রশ্নে থামলো প্রদিপ।
-অন্তরাকে আমি আল্লারাখার মত সৎ কর্মঠ মানুষের সাফল্যের উপযুক্ত ফসল হিসেবে চিন্তা করি। ওদের দুজনকে অন্যান্য ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের জন্য অনুপ্রেরনার রোল মডেল হিসেবে দাড় করাবো বলে আমার একটা লেখা পত্রিকায় ছাপানোর জন্য সব এডিটিং শেষ করে লেখাটা একদম শেষ পর্যায়ে এনেছি।
-সেত খুব ভালো কথা বাবা।
উল্লাসিত বোধ করলেন রেবেকা বেগম।
থামলো প্রদিপ। ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে।
-চারিদিক মোটা সোটা হৃষ্টপুষ্ট সব গাছের মধ্যে গজিয়ে ওঠা সরু লম্বা গাছটি যা সূর্যের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অন্য সব গাছকে ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি দিচ্ছে, ওটার ডগার পরিস্ফুটিত ফুলটি যদি নিজ জন্মদাতা গাছের স্যাঁতসেঁতে কদর্য গোড়াকে অস্বীকার করতে চায় তাহলে কেমন হয় মা?
-তুই কি বলচিস পরিষ্কার করে বলতো?
-হে তায় বলছি মা। অন্তরার রূপ লাবন্য জ্ঞান গরিমার কাছে বোধহয় ওর বাবার ওই চেহারাটা বড্ড বেমানান। তায়তো তাকে অস্বীকার করে সিংগাপুরবাসী এক কাল্পনিক মানুষকে ওর বাবা সাজাতে চায়।
নিস্তুব্দ সবায় কিছুক্ষন।
-আহ আমার কল্পনার রোল মডেল! কিছুটা স্বগত স্বরে কথাটা বলে প্রদিপ যেন নিজের ভাবনাকে কটাক্ষ করলো।
ছেলের কথাবর্তায় হতবাক হয়ে রইলেন ওরা দুজন।
নীরবে বেরিয়ে গেল প্রদিপ।

সব কিছুই কেমন যেন এলোমেলো লাগতে লাগলো।
-আমার মনে হয় কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে কারো। অন্তরা সম্পর্কে প্রদিপের অমন মন্তব্য, প্রদিপের সাথে বিয়ের প্রস্তাবে আল্লারাখার অমত। এ সব কি হচ্ছে রেবেকা?
আল্লারাখার বাগানে একাকী ঘোরা আর ওখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করা আর ফিরে আসার পর তার বিষণ্ণতা! এ সব এতদিন নিচক ঘটনা মনে হলেও আজ ওগুলো বিশেষ অর্থবহ মনে হতে লাগলো তাদের কাছে।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.