অসহায় মানুষ -১৬

 

প্রদিপ এবাড়ীতে আসলে আল্লারাখার সাথে বেশী কথা বার্তা না হলেও নানা কাজের অছিলায় ও চোখে চোখে রাখে প্রদিপকে। প্রদিপ তা বুঝতে পারে। ব্যপারটা অন্তরার চোখও এড়াতে পারে না।
প্রদিপ এ বাড়ীতে আসতে কয়েক দিন দেরী করলেই একটা না একটা কিছুর ছুতোই আল্লারাখা ও বাড়ীতে যায়।
আল্লারাখা অল্পশিক্ষিত সেকেলে মানুষ। অন্তরার মত মানষিকতা বা ওদের আর্থিক অবস্থার সাথে চাক্ষুস বেমানান। প্রদিপ অনেকবার ভেবেছে একদিন প্রসঙ্গক্রমে কথাটা জিজ্ঞেস করবে অন্তরাকে।
ব্যপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে। বাবা হিসেবে অন্তরার প্রতি তার ভালবাসা আর বাবার প্রতি অন্তরার প্রগাঢ় সন্মানবোধ। এতসব চিন্তা করে নিজের মনের এ অমুলক চিন্তাটা কখনো যেন প্রকাশ না পায় সে ব্যপারে সবসময় সচেতন প্রদিপ।
-ছোট বয়সে মাকে হারানোর পর বাবাই ওর সব।
একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল অন্তরা।
তাছাড়াও আল্লারাখা যে প্রদিপকে অকৃত্তিম ভাবে ভালবাসে তা বুঝতে পারে প্রদিপ। এবাড়ীতে আসলে প্রথম দেখা হলেই আল্লারাখা প্রদিপকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। অনেকক্ষন ধরে জড়িয়ে রাখে। বিদায় নেয়ার সময়ও আবার জড়িয়ে ধরে একই ভাবে।
আল্লারাখার হাড্ডিসার বুকের উষ্ণতার স্বাদটায় অন্যরকম। আর তায় নিজের অজান্তেই এ বাড়ীতে আসলে ওর সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কি যেন একটা অপূর্ণ থেকে যায় প্রদিপের।

গরমের সময়। একদম ম্যাজমেজে গরম পড়ছে। ঘরের ভিতর বসার মত না। অন্তরা প্রদিপকে নিয়ে সামনের লনে বসেছে। কাজের লোকটাকে বলে ড্রইং রূমের একটা প্লাগ পয়েন্ট থেকে মাল্টিপ্লাগের সাহায্যে তার টেনে প্যডেস্টাল ফ্যানটা লনে লাগিয়ে বসেছে ওরা।
হটাৎ করেই কারেন্ট চলে গেল। প্রায় সাথে সাথেই আল্লারাখা একটা তালের পাখা নিয়ে বেরিয়ে আসলো।
-এই গরমের মধ্যে কারেন্ট চলে গেল!
কথাটা বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে বসলো ওদের পাশে।
পাখাটা ঘুরিয়ে দুজনকেই বাতাস করতে লাগলো আল্লারাখা। অবাক দুজনই, মনে হল আল্লারাখা যেন জানতো এ সময় কারেন্ট যাবে তাই হাত পাখা নিয়ে রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিল।
বাবার এ আদর অন্তরার কাছে নতুন কিছু না হলেও প্রদিপ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো।
-আপনি পাখাটা আমাকে দিন আমি বাতাস করি।
-না বাবা থাক।
প্রদিপ তবুও পিড়াপিড়ি করতে লাগলো।
-প্রদিপ, হাজার চেষ্টা করেও এমন একটা সুযোগ থেকে বাবাকে তুমি নিরাস্ত্র করতে পারবে না।
অন্তরার মন্তব্যে ওর অযথা প্রচেষ্টায় খ্যান্ত দিল প্রদিপ।
সেদিন বেশ কিছুক্ষন ধরে কথা বললো ওরা বসে।
-এতক্ষন ধরেতো কারেন্ট বন্দ থাকার কথা না, কি এমন হল?
বাড়ীর কাজের লোকটাকে নজরে পড়তেই অন্তরা কথাটা ওকে বললো।
একটু বাদেই কারেন্ট আসলো। হন্তদন্ত হয়ে উঠে ভিতরে চলে গেল আল্লারাখা।
দাত বের করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসলো ঘরের ভিতর থেকে কাজের লোকটা।
-কারেন্ট যায়নি আপামনি।
-তবে?
-মেইন সুইচ অফ ছিল।
আশ্চার্য্য হয়ে ওরা দুজনই একে অপরের দিকে তাকাল।

প্রদিপের প্রতি আল্লারাখার ভালবাসার স্বরূপটা বোধগম্য নয় অন্তরার। ভেবেছে বিষয়টা নিয়ে কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারেনি।
তবে বিষয়টি নিয়ে ও একদিন জিজ্ঞেস করেছিল আল্লারাখাকে।
-ওকে ভালবাসলে কি তোরটা কমে যাবে?
মৃদু হেসে জবাব দিল আল্লারাখা।
-তানা, তবে তুমি মাঝে মাঝে যে ছেলেমি করো!
-কেন সব কিছু কি তোর পছন্দ মত করতে হবে। আমার কি নিজের কোন পছন্দ অপছন্দ বলে কিছুই নেই।
হটাৎ করেই যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো আল্লারাখা।
অবাক হয়ে গেল অন্তরা। কারণ এত দিনের পরিচিত আল্লারাখার এ চেহারা যে ওর একদম অপরিচিত।
অবাক লাগলো আল্লারাখার নিজের কাছেও। কথাটা বলেই যেন ও খুজে পেল নিজেকে।
-বুড়ো হয়ে গিয়েছি মা, তাই কি বলতে কি বলে ফেলি।
আর দাড়ালো না আল্লারাখা। হন হন করে হেটে চলে গেল।

বেশ কয়েকদিন হল এ বাড়ীতে আসে না প্রদিপ। প্রতিদিন অপেক্ষা করে করে অনেকটা অধৌর্য্য হয়ে অন্তরাকে কারণটা জিজ্ঞেস করলো আল্লারাখা।
কি জবাব দেবে অন্তরা তা ঠিক ভেবে পাচ্ছিলো না। কারণটা ও জানে কিন্তু তা আল্লারাখাকে কি করে বলবে।

সেদিন প্রদিপের সাথে কথা বলতে বলতে আল্লারাখার প্রসঙ্গ উঠেছিলো।
আল্লারাখার সাথে অন্তরার প্রকৃত সম্পর্ক, ওর মা বাবা ইত্যাদি ব্যপারগুলো সম্পর্কে প্রদিপকে বলার কোন তাগিদ কখনো বোধ করেনি অন্তরা।
প্রথমতঃ বিষয়গুলো একান্ত ওর নিজের। অধিকন্তু সেগুলো অত ঝলমলে নয় যে অন্যকে বলে ঝলমলে ভাবটা বাড়ানো যাবে।
আল্লারাখা সম্পর্কে প্রদিপের একটা মন্তব্যের প্রেক্ষিতে নিজের সম্পর্কে ওই অপ্রাঙ্গিক আর অপ্রিয় সত্যটা অন্তরাকে বলতে হয়েছিল সেদিন।

-তোমার মায়ের সাথে তোমার বাবার কোন ছবি নেই?
-কেন বলতো?
-না কখনো দেখিনিতো তায়।
বোধহয় নিচক কৌতুহল। ভাবলো অন্তরা।
-তোমার মায়ের ছবি দেখে যা মনে হয় তিনি ছিলেন রূচিশীলা শিক্ষিতা অথচ তোমার বাবা কেমন সাদামাঠা।
এতক্ষনে ও বুঝলো প্রদিপের প্রশ্নের কারণটা।
-বাবাও পোশাক পরিচ্ছদে অনেক স্মার্ট। তাকে তুমি দেখনিতো তায়।
-দেখিনি মানে?
অবাক হলো প্রদিপ।
-কারণ তিনি এখানে থাকেন না।
তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রদিপ।
– আল্লারাখা আমার প্রকৃত বাবা নন তবে তিনিই আমার সবকিছু।
-হেয়ালী করোনাতো। বাবাতো বাবাই তা তিনি যাই হোক না কেন।
এবার অবাক হলো অন্তরা। বিরক্তও হলো প্রদিপের মন্তব্যে। এ সত্যিটা মেনে নিতে প্রদিপের সমস্যা কোথায় তা ঠিক বুঝলো না অন্তরা।
-আমার বাবা সিংগাপুর থাকেন, অনেক আগে থেকে।
-কেন!
অবান্তর প্রশ্ন, ভাবলো অন্তরা। প্রদিপের অমন অনধিকার চর্চায় কিছুটা বিরক্তও হলো অন্তরা। একবার ভাবলো কোন জবাব দেবে না।
-মায়ের সাথে বাবার সম্পর্ক ভাল ছিল না তায়।
-বুঝেছি।
-কি বুঝেছ?
প্রদিপের উত্তরটা মোটেও ভালো লাগলো না অন্তরার।
-শোন অন্তরা যা হওয়ার তা হয়েছে তার জন্য যে কেউ দায়ী হোক তুমি দায়ী নও। আর তোমার বাবা এমন একজন সরল ভাল মানুষ যে তার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আমিও তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি।
-কি বলতে চাও তুমি?
ধৌর্য্য হারানোর উপক্রম হলো অন্তরার।
-আমার বাবা সম্পর্কে অন্য কারো সার্টিফিকেটের কোন দরকার নেই। তুমি তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম কর আর আমি তার পা দুটো প্রায় প্রতিদিন ধুইয়ে দিই।
ভীষণ রাগ হলো অন্তরার। সত্যি বলতে আল্লারাখা ওর জন্মদাতা বাবা হলে প্রকৃতই খুশী হতো ও। আর যেটা ওর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার তা নিয়ে প্রদিপের অত কৌতুহল কেন! আর ও কি করে ভাবলো যে আমার পরিচয় আমি গোপন করছি?
-তোমার যা ইচ্ছা তা তুমি ভাবতে পার। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যপার আর তায় আমি চায় না এতে কেউ নাক গলাক।
-উত্তেজিত হয়োনা অন্তরা তোমার মত বাস্তববাদী একজন মানুষের উত্তেজিত হওয়া মানায় না। ঠিক আছে মানছি, আল্লারাখা তোমার বাবার মত বাবা নয়।
এবার সত্যি সত্যিই অন্তরা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাড়ালো।
-আমি যাচ্ছি। তোমাকে আমার আর একটুও সহ্য হচ্ছে না।
-তাহলে তোমার কলেজের নথিপত্র।
এত কিছুর পরও জীবনটাকে টেনে টেনে এগিয়ে নিচ্ছিল অন্তরা। সব কিছুকে মেনে নিয়ে নিরব প্রতিবাদ হিসেবে ওর সব ডকুমেন্টে বাবার নামের জায়গাই আল্লারাখার নাম লিখেছিল। নিজের ইচ্ছে আর মায়ের সম্মতিতে। ভেবেছিল তাতে করে ওদের জীবনে যদি আল্লারাখার কাছে ঋণের বোঝাটা কিছুটা হালকা করা যায়। এমনকি আল্লারাখাও ব্যপারটা জানে না।
আজ প্রদিপ সম্পুর্ণ অযাযিত ভাবে ওর অতি কষ্টে গড়া সে নড়বড়ে ঘরটা ভেঙে দিতে চাচ্ছে।
-প্লিজ তুমি চলে যাও। আর কখনো আসবে না এখানে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বেরিয়ে গেল অন্তরা।

সেদিন থেকে প্রদিপ আসে না এ বাড়ীতে।
কিন্তু কি করে বলবে অতসব কথা আল্লারাখাকে!
– প্রদিপ বোধহয় আর আসবে না এ বাড়ীতে।
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর এরকম একটা মন্তব্য অবাক করলো আল্লারাখাকে। অন্তরার দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্তরা। মানষিক ভাবে বিপর্যস্ত লাগছে ওকে।
এতটুকু বয়স থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে মেয়েটাকে। দুখী মেয়েটা কিন্তু সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে জীবনটাকে এগিয়ে নিচ্ছিলো। এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় আগে কখনো দেখিনি ওকে।
কি হয়েছে ওর! একটা অকল্পনীয় সম্ভাবনা ওর মনে উকি দিতেই চুপসে গেল আল্লারাখা। ভাবল না, মেয়েকে জীবনের এ পর্যায়ে ওরকম অপ্রীয় আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক সত্যের মুখোমুখি হতে দেবে না কিছুতেই।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.