অসহায় মানুষ -১৫

 

নেওয়াজ পরিবারের আসা উপলক্ষে সব আয়োজন করার কাজে মনোনিবেশ করলো এ বাড়ীর সবাই।
নিজ হাতেই সব করলো আল্লরাখা। ও পরিবারের সবাইকে আপ্যায়ন করার ব্যপারে আল্লরাখার স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে খুব ভালো লাগলো অন্তরার।
আল্লরাখাকে খুশী করার জন্য অন্তরাও ওর সাথে হাত লাগালো।
এ বাড়ীর মানুষ এই প্রথম যেন আপন কারো আগমন উপলক্ষে অভ্যার্থনা দেয়ার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আয়োজনে মেতে উঠেছে।
সেদিন সকাল থেকেই ওদের আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগলো ওরা।
-অন্তরা মা তুই উপরে যেয়ে বিশ্রাম কর ওরা আসলে আমি খবর দেব তোকে।
আল্লরাখার উচ্ছাস দেখে মৃদু হাসলো অন্তরা।
-বাবা ঘড়ি দেখেছ তুমি, এখন সকাল সাতটা ওরা কোন ক্রমেই দশটার আগে পৌছাতে পারবে না। আর গেটে দারোয়ানতো আছেই।
অন্তরার কথায় যেন নিজেকে খুজে পেল আল্লরাখা। শান্ত হয়ে বসলো সোফার উপর। ঈশারা করে অন্তরাকেও বসতে বললো।
আল্লরাখা যেন নিজের অহেতুক উচ্ছ্বাসের বেমানানটা বুঝতে পেরেছে। কেমন যেন হতবুদ্ধি মনে হচ্ছে ওকে।
-আচ্ছা বাবা সেদিন প্রদিপের কথা কি যেন বলছিলে -ও বস্তিতে কিছু একটা খুজতে খুজতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে বলে তুমি মন্তব্য করেছিলে।
-হে মা, ওর সাথে কথা বলে তায় মনে হয়েছে আমার। কিছু একটা খুজতে খুজতে ও দেহ মন দুয়ে মিলে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ওখানে। কিন্তু মূল সত্যটা কিভাবে ঘুচাবে ও! মনে প্রাণে ওদের একজন হয়ে গেলেও ওর যে বাইরের জগত সম্মদ্ধে জ্ঞান আছে, বস্তির বাইরের ঝলমলে জগতটাতো ওর জানা। যার সন্ধান বস্তিবাসীদের জানা নেই।
কথা বলতে বলতে আল্লারাখা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। অন্তরা তাকিয়ে ছিল আল্লরাখার মুখের দিকে।
-প্রদিপের ভাবনায়, বস্তি আর বাইরের পৃথক স্তরের দুটি জীবন প্রবাহের গতি প্রকৃতি আলাদা হলেও লক্ষ একই অভিন্ন। সুখ দুঃখের যে অসমতা আমরা বাইরে থেকে দেখি, অংকের হিসেবে তার মিল থাকলেও স্তর বিশেষের আকাঙ্ক্ষার সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ। তায়তো উঁচু তলার কেউ ওদের জন্য কিছু করতে যাওয়াটাকে ছেলেটা এক ধরনের স্বার্থপরতা মনে করে।
অন্তরা শুনছিলো ওর কথা নিশ্চুপ ভাবে। কোন এক ভাবনায় ডুবে গেল আল্লরাখা। নিশ্চুপ দুজনেই।

-মাধুকরী পরদিন ক্লিনিকে এসেছিলো প্রদিপের খোজ নিতে।
অন্তরা নিরবতা ভঙ্গ করলো।
-প্রথমদিন খুব ছটফট করেছিল প্রদিপের খোজ জানার জন্য। ও কোথায় আছে সে জাইগার ঠিকানা দেয়ার জন্যও পীড়াপিড়ি করেছিল সেদিন। পরে আরো কয়েকবার এসেছে ও। তবে ইদানিং আর আসেনা।

কথায় কথায় কত বেলা হয়েছে তার খেয়াল কারোরি নেই।
খেয়াল হলো দারোয়ানের ডাকে।
প্রদিপ আর ওর বাবা মাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলো ওরা।
হাসি মুখে ওদেরকে স্বাগত জানিয়ে বসালো।
প্রদিপ ভাল করে দেখলো অন্তরা আর ওর বাবাকে। এ কয়দিনে প্রদিপ অনেক ভেবেছে এ দুটি মানুষকে নিয়ে। আপাতঃ দৃষ্টিতে বৈশাদৃষ্য বাবা মেয়ের চেহারা। অন্তরা শিক্ষিতা আধুনিকা সুন্দরী আর আল্লারাখা চেহারা কথাবর্তা জ্ঞান গরিমায় যেন এই বাড়ীটাতে বেমানান। অথচ এই সংসার বাড়ী গাড়ী সব কিছুই তার। এ সত্যিই এক ব্যতিক্রম।
-তা তোমার শরীর এখন কেমন?
-হ্যে ভাল।
আল্লারাখার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকা প্রদিপ যেন চমকে উঠলো একটু।
-চাকরীটা ছাড়াতে না পারলে আবার পোকা মাথায় ঢুকতে কতোক্ষন। ওর এনজিও’র চিফের সাথে কথা বলে তাকে সব জানিয়েছি আমরা।
মায়ের কথায় সেদিকে তাকালো প্রদিপ। একটু যেন অন্যমনষ্ক।
-তোমার থিসিসের–
কথা শেষ না করেই মাঝপথে থামলো অন্তরা। সন্মোধনটা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটা ভেবে নিল।
-বলছিলাম তোমার থিসিস কতদুর এগুলো।
-প্রায় শেষ করে ফেলেছি। সুপারভাইজরের সাথে আরো কয়েকবার বসতে হবে।
চোখা চোখি হলো ওদের।
-অন্তরা তুই কথা বল মা আমি দেখি ওদিকটায়।
-তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না বাবা আমি সব বলে রেখেছি সব রেডি করে খালা বলবে আমাদেরকে।
কিছু একটা বলবে বলবে করে ইতস্ততঃ করতে লাগলো আল্লারাখা।
-সকালের নাস্তার কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছো এই তো?
অন্তরা মৃদু হাসলো বাবার দিকে তাকিয়ে।
-তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না, আমিতো তোমারই মেয়ে না কি, তায় জানতাম তুমি ভুলে যাবে। আমি সব ব্যাবস্থা করেছি।
বাবা মেয়ের এই চমৎকার সম্পর্ক মুগ্ধ করলো নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রীকে।
-না না সে কি কথা, একেতো ভোরে আমরা নাস্তা করে বেরিয়েছি। তাছাড়া মাঝে ব্রেক দিয়ে চা নাস্তাও খেয়েছি।
মিষ্টি করে মুচকি হাসলো অন্তরা।
-আন্টি আপনার কথার প্রেক্ষিতে আমার এক পেশেন্টের কথা মনে পড়লো।
অন্তরার কথায় সবাই তাকালো ওর দিকে।
অন্তরার বয়স তেমন বেশী না হলেও ওর পরিপক্কতার লেভেল বেশ উচুতে তা বুঝলো ওরা সবাই।
-ইনটার্নশীপ করার সময় হাসপাতালে আমি সেদিন ডিউটি ডক্টর। মেডিক্যাল ইনসপেকশান রূমে বেডে একটা রূগীর ব্যন্ডেজ পরীক্ষা করছি অন্য একজন রুগী আসলো। মটর সাইকেল থেকে পড়ে কনুয়ের নিচে ছিলে রক্ত ঝরছে।
আমি ওকে পাশের বেডে শুতে বলে নার্সকে বললাম জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বাধতে। অল্প বয়সী পেসেন্ট মনে করলো আমি বোধহয় ওর প্রতি সমপরিমাণ গুরূত্ব দিলাম না। ছেলেটি অভিমান করে নার্সকে বললো -ঠিক আছে ব্যান্ডেজটা আমাকে দিলে আমি বাড়ীতে যেয়ে নিজেই তা বেধে নেব।
সবাই শুনছে অন্তরার কথা।
-শুনলাম ওর কথা কিন্তু বললাম না কিছু।
-হাতের কাজটা সেরে ঘুরতেই দেখি ছেলেটা ব্যন্ডেজ হাতে দরজায় দাড়িয়ে। মলিন মুখে আমাকে বললো -ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে, খুব ব্যথা করছে, ব্যন্ডেজটা একটু বেধে দিন না দয়া করে।
হো হো করে হেসে উঠলেন নাসিম জোয়ারদার আর তার স্ত্রী।
-ওটাকে বলা যায় পেসেন্ট সাইকি।
-আমরা এখানে কেউ পেসেন্ট না। প্রদিপের মন্তব্যে অন্তরা তাকাল ওর দিকে।
– প্রদিপ, পেষেন্ট সাইকি’র সাথে হাঙরি ম্যান সাইকি’র কিন্তু মিল আছে। আর তোমার ব্যপারতো আরো জটিল কারণ আন্টি আংকেলের যে কোন মেনু চললেও তোমার মেনুটা আমাকেই ভেটিং করতে হবে কারণ তুমি আমার পেসেন্ট।
সবাই হেসে উঠলো।
-তা হলেতো আমার চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে।
হাসতে হাসতে সবাই তাকালো প্রদিপের দিকে।
-কারণ এখন জানলাম নাস্তার মেনুটা তুমিই দিয়েছ, পেসেন্ট মেনু।
নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী হাসির অতিশয্যে চোখ মুছতে লাগলেন।
অনেকদিন পর মন খুলে হাসতে পেরে সবাই খুব হালকা বোধ করলো।
খাবার রেডি বলে জানিয়ে গেল খালা। কথা শেষ করে আসছি বলে আল্লারাখা যেতে বললো তাকে।
-হাসা হাসি করে সত্যিই খিদে পেয়েছে। ম্যাডাম সত্যিই ভুল হয়েছে আমাদের খুব খিদে লেগেছে তাড়াতাড়ি খাবার দিন।
নাসিম নেওয়াজের মন্তব্যে সবাই আবারো হাসিতে ফেটে পড়লো।
লজ্জায় যেন লাল হয়ে গেল অন্তরা।
বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নাসিম নেওয়াজ অন্তরার কাছে গেলেন। স্বস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।
-এত অল্প পরিচয়ে তুমি আর তোমার বাবা যে আমাদেরকে এতখানি আপন করে নিয়েছ তার জন্য সত্যিই আমরা কৃতজ্ঞ।

পুরো দিনটা একসাথে কাটালো ওরা হাসি তামাসায়।
সবাই কম বেশী কথা বললো হাসা হাসি করলো। কেবল আল্লারাখাকে একটু বেশী চুপচাপ মনে হলো। আল্লারাখা কাজের ফাকে ফাকে অন্যমনষ্কভাবে প্রদিপকে দেখছিলো বারবার। ব্যপারটা খেয়াল করলো সবাই।
সুন্দর একটা দিন কাটিয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরলো ওরা।

এর পর থেকে দুটো পরিবারের মধ্যে যাতায়াত আর হৃদ্যতা বেড়েই চললো। নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা নেওয়াজ দুজনেরই খুব পছন্দ অন্তরাকে। ওকে ছেলের বউ করে আনতে পারলে খুশি হবেন দুজনাই এমন ভাবনা ওদের মনে স্থান গাড়লো।
প্রদিপ আর অন্তরার কার্য্যকলাপ কথাবর্তায় যা বুঝেছে ওরা তাতে মনে হয়েছে ওদেরও অমত থাকার কথা না।
ওদিকে প্রদিপের প্রতি এক প্রাগাঢ় মমতা জন্ম নিয়েছে আল্লারাখার হৃদয়ে। যা ওর কথাবার্তা কার্য্যকলাপে পরিষ্কার বোঝা যায়।
প্রদিপকে পছন্দ করে অন্তরা। অন্য দশটা ছেলের থেকে কিছুটা আলাদা ভাবে ওকে দেখলেও এ বয়সে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের যে স্বতঃস্ফূর্ত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠার কথা তেমন কোন তাড়না অনুভব করে না অন্তরা।
প্রদিপ মাঝে মধ্যে আসে কথা হয় অন্তরার সাথে একান্তে।
আল্লারাখার সাথেও দেখা হয়। তবে ওদের কথাবার্তা শারীরিক খোজখবর নেয়ার অধিক গড়াতে পারে না। কারণ এ দুটি অসম বয়সী মানুষের মধ্যে চিন্তা চেতনার যে অসমতা তা দুজনেই অনুধাবন করতে পারে একটুতেই।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.