অসহায় মানুষ -১৪ 

 

-অত বড় বস্তিতে লক্ষ মানুষের বসবাস সেখানে বলতে গেলে শরীর খারাপ হওয়ার এ রকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। আমি বড় লোকের ছেলে তায় ওরা ঘাবড়ে যেয়েই অত সব কান্ড করে বসলো। আমার মত অসুস্থতা নিয়ে বস্তিতে যারা পড়ে আছে তাদের জন্যও সবারই কিছু করা দরকার।
সবাইকেই একটু অবাক করলো প্রদিপের মন্তব্য। তবে আল্লারাখা খুব আগ্রাহান্নিত হয়ে উঠলো ওর কথায়।
-তায়তো বাবা ওদের জন্য আমাদের সবারই কিছু না কিছু একটা করা দরকার।
আল্লারাখার মন্তব্যে সবার নজর ফিরলো ওর দিকে।
-সরকারী একটা ক্লিনিক আছে ওখানে, কিন্তু ডাক্তারের দেখা মেলে না। আমিই অন্তরাকে কথাটা বলেছিলাম। আমার কথায় মেয়েটাও রাজি হলো। সেভাবেই ছুটির দিনগুলোতে ও নিয়মিত বসে ওখানে।
নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগম অপলকনেত্রে শুনছেন আল্লারাখার কথা।
-মেয়েটা যখন অপুষ্টি আর জ্বরাজীর্ণতায় আকণ্ঠ হাবুডুবু খাওয়া মানুষগুলোকে পরীক্ষা করে আমি তখন এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে ওকে সাহায্য করি আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি মানুষগুলোকে।
একদম অন্যমনষ্ক বৃদ্ধ আল্লারাখা।

-মানুষকে দয়া দেখানোর কি অভাবনীয় সুযোগ ওখানে!
প্রদিপের এধরণের কঠোর মন্তব্যে উপস্থিত সবাই যেন সজোরে ধাক্কা খেয়ে তাকালো ওর দিকে।
আল্লারাখার আবেগপ্রবন কথার উত্তরে ছেলের অমন মন্তব্যে নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগম রীতিমত অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
প্রদিপের অমন নিরেট মন্তব্য মরমে আঘাত করলো আল্লারাখাকে। ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো আল্লারাখার দু’চোখের কোণা গড়িয়ে।
হতবাক নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগম।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো আল্লারাখা।
-আমি মুর্খ্য মানুষ। নিজের উপর দখল নেই একদমই। তায় মনের মধ্যে যা ঘটে তার সবই বাইরে প্রকাশ পায়।
দুচোখ বয়ে অঝরে জল গড়িয়ে পড়ছে আল্লারাখার।
-নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই বলেইতো আজ আমার এ দশা।
রূমাল বের করে চোখদুটো মুছে নিল আল্লারাখা।
-কি উদ্দেশ্য তা সঠিক করে বলতে পারবো না বাবা। তবে আমার বা অন্তরার মনে দয়া দেখানোর কোন ধৃষ্টটা নেই তা তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি।
এবার আল্লারাখার কান্নার শব্দটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
– প্রদিপ, কি বলেছিস তার অর্থ বুঝিস তুই। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
নাসিম নেওয়াজ আল্লারাখার অবনত মস্তকে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ওর মন্তব্যে আল্লারাখার ভিতর এরকমন আবেগের সৃষ্টি হওয়াই প্রদিপও কিছুটা অপ্রস্তুত ও হতবাক হয়ে গেল।

পাতলা মেদবীহিন শরীর আল্লারাখার। মাথার চুলগুলো সাদা ধপধপে, মুখভর্তি দাড়ি। শরীর দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় খেটেখাওয়া মানুষ।
বস্তিবাসীদের দৈন্যতাকে দয়া দেখানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহন করা অনেক মানুষকে দেখেছে প্রদিপ। আল্লারাখা আর তার মেয়েকে তাদেরই একজন বলে ভুল করে এসব লোক দেখানো মানব সেবার পিছনে ওদের সাজানো যুক্তিগুলোর স্বরূপ বোঝার জন্যই পরিকল্পিত ভাবে ওরকম একটা কঠোর মন্তব্য করেছিল প্রদিপ।
-আমি দুঃখিত, আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, ক্ষমা করবেন আমাকে।
অনুতাপ প্রকাশ করলো প্রদিপ।
-ওখানে যারাই যা কিছু করূক তাদের অধিকাংশই লোক দেখানো অথবা ওদেরকে সস্তায় কেনার জন্য করে কিনা, তায়তো ওধরণের মানুষদের ঘৃণা করি আমি।
প্রদিপের এ মন্তব্য দারূন ভাবে ধাক্কা দিল আল্লারাখাকে।
নাসিম নেওয়াজ হতবাক হয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। চোখাচোখি হলো দুজনের। কিন্তু কোন কথা কেউ বললো না।
সোফা থেকে উঠে প্রদিপের পাশে বসলো আল্লারাখা। হাত রাখলো প্রদিপের মাথায় শান্তভাবে। আলতো ভাবে ওর মাথায় হাত বুলালো কিছুক্ষন।
-তোমার পড়াশোনা আর চাকরীর তথ্য সংগ্রহের বাইরে কি কিছু খোজ করছো তুমি সেখানে বাবা!
সবাই অবাক হলো আল্লারাখার আচমকা প্রশ্নে।
হতবিহবল প্রদিপ নিজেও।
-ওটা আলাদা এক জগত। তবে অন্য সব জগতের মতই অতল। তায় খোজার গন্ডি যদি কোন সীমায় বাধা না হয় তবে তুমি যে হারিয়ে যাবে। গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে অসংখ্য রংবেরঙের ঝিনুক শামুক দেখে যদি নিজেকে হারিয়ে ফেল তবে তোমার খোজা মানিকের সন্ধান পাবে কি করে?
একটু থামলো আল্লারাখা।
-যত গভীরই হোক সব কিছুর হিসেব তাঁর ঠিকই আছে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
কথাটা বলে উঠে দাড়ালো আল্লারাখা। আরো একবার প্রদিপের মুখের দিকে গভীর ভাবে তাকালো।
-যায়, বেলা থাকতে ফিরতে হবেতো। মেয়েটা একদম একা।
আরেকটু বসার অনুরোধ উপেক্ষা করে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আল্লারাখা। ওকে বিদায় দিতে বেরিয়ে গেল নাসিম নেওয়াজ।
প্রদিপ আর রেবেকা বেগম সেদিকে তাকিয়ে রইলো যতদুর দেখা যায়।

আল্লারাখার কাছ থেকে প্রদিপের শারিরীক অবস্থা জেনে আশ্বস্থ হলো অন্তরা।
-যতদুর জেনেছি প্রদিপ একটা এনজিও’তে কাজ করে। আর সেই এনজিও’র কাজে তথ্য সংগ্রহের জন্যই ওই বস্তিতে যাতায়াত এবং পরবর্তিতে ওখানে থাকা শুরূ করে।
-ঠিকই শুনেচিস। কিন্তু ওকে দেখে আমার কি মনে হয় জানিস মা।
আল্লারাখার কথায় অন্তরা তাকালো ওর মুখের দিকে।
-ও বাধা পড়েছে কোন এক অজানা মায়ার জালে। আর ওখানে থাকতে থাকতে বস্তিবাসীর শত কাহিনীর ভীড়ে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। ও নিজে সে সব কাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে সবকিছুর মধ্যে এক অভিন্নতার সন্ধান পেয়েছে।
-ঠিক বুঝলাম না।
-তানা হলে অত দরদ কেন ছেলেটার মনে!
অন্যমনষ্ক ভাবে জবাব দিল আল্লারাখা।
অন্তরার একাকী জীবনের সবটুকু জুড়ে আছে বৃদ্ধ এই মানুষটি। আল্লারাখা অন্যমনষ্ক হলে ওকে বড় অসহায় লাগে।
আল্লারাখা তার নিজের বাবা মা আত্মীয় পরিজন সম্পর্কে কিছুই জানে না।
অন্তরার দাদা সেলিম তরফদার একবার তার ব্যবসায়ীক কাজে সীমান্তের কাছে একটা রেষ্ট হাউজে ছিলেন কিছুদিন। ওই রেষ্ট হাউজের বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের কাছে প্রথম দেখেছিল সাত আট বছর বয়সী আল্লারাখাকে।
আল্লারাখা সেলিম তরফদারের জামাকাপড় ধুয়ে দিত আর ঘর গুছিয়ে দিত।
আসবার সময় আল্লারাখা সেলিম তরফদারকে বলেছিল ওকে কাজের ছেলে হিসেবে নিতে। বৃদ্ধ কেয়ারটেকার কোন আপত্তি করেনি। বরং খুশী হয়েছিল।
-যাক, অনাথের যদি একটা গতি হয়। আশ্বস্ত হয়েছিল বৃদ্ধ কেয়ারটেকার।
আল্লারাখা কেয়ারটেকারের আপন কেউ ছিল না আর নামটাও ওর আসল নাম না। কেয়ারটেকার ওকে সীমান্ত এলাকায় কুড়িয়ে পেয়েছিল ওর বয়স তখন দুই তিন বছর হবে। কোন কিছুই বলতে পারিনি নিজের সম্পর্কে। এমনকি নামটা পর্যন্তও না। তারপর থেকেই থাকতো কেয়ারটেকারের কাছে। সীমান্তে কুড়িয়ে পাওয়া অনাথ ছেলেকে ও নামেই ডাকতো কেয়ারটেকার।
-বাবু ও বড্ড অভিমানী আর একরোখা। মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় ওর ওপর কিন্তু ওর পোড়া মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারি না। তবে নিজ থেকেই শান্ত হয়ে যায় একটু বাদেই। আল্লারাখাকে সেলিম তরফদারের হাতে তুলে দিয়ে কথাগুলো বলেছিল বৃদ্ধ কেয়ারটেকার।
সেলিম তরফদারের সাথেই আল্লারাখা এসেছিল ওদের বাড়ীতে। তারপর দিনে দিনে সে পরিবারেরই একজন সদস্য হয়ে গেল।
বড় একা আল্লারাখা এ বিরাট পৃথিবীতে। একটু অন্যমনষ্ক হলেই ওর ভিতরের শুণ্যতা মুখের উপর প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
ভারী মায়া লাগে অন্তরার।
-অন্তরা, ওদেরকে একদিন ডাকবো নাকি আমাদের এখানে।
একটু অবাক হলো অন্তরা আল্লারাখার কথায়। ওর প্রস্তাব অসংগতীপূর্ণ মনে হলো কিছুটা। বলতে গেলে ও বাড়ীতে যেয়ে ওকে দেখে আসার ব্যপারটাও কেমন অসমীচীন লেগেছে অন্তরার কাছে।
অন্তরা চুপ করে রইলো। আল্লারাখার কোন কথা সাধারণত ফেলে না অন্তরা।
-দেখ তুমি যেটা ভাল বোঝ।
-জানিস ছেলেটাকে আমার কাছে সবার থেকে আলাদা মনে হয়।
আবার অন্য মনষ্ক হয়ে গেল আল্লারাখা।
-ঠিক আছে, এখনতো আমাদের সবদিনই অবসর বলা যায়। বলনা ওদেরকে আসতে যে কোন দিন।
আশ্বস্থ হলো আল্লারাখা।

আল্লারাখা কয়েকদিন পর আবার নিজেই গেল ওদের আসার কথা বলতে।
-আপনি অত কষ্ট করে এত পথ আসতে গেলেন কেন, টেলিফোন করলেইতো হতো।
-তা হতো। তবে মনে করলাম প্রদিপকেও দেখে যেতে পারবো একটু।
আল্লারাখার কথায় নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী তাকালো একে অপরের দিকে।
ড্রইং রূমে বসে কথা বলছিলো ওরা। প্রদিপ এসে বসলো মায়ের পাশে একটা সোফায়।
– প্রদিপ, দেখ এত কষ্ট করে তোকে দেখার জন্য এসেছেন তিনি।
-কি সর্বনাস, আমিতো ভাল এখন। আপনি আবার এত কষ্ট করতে গেলেন কেন?
-বিভিন্ন সময় মেয়েটার জন্য কষ্ট করার ব্যপার নিয়ে অন্তরা যখন অমন কথা বলে তখন আমি কি জবাব দিই জান?
সবাই তাকালো আল্লরাখার দিকে।
-বলি, আমিতো তোর আসল বাবা না সেজন্যই তোর অমন মনে হয়।
আল্লারাখার কথার অর্থ ঠিক বুঝলো না কেউ।
-সে কথা থাক, এখন বলেন কবে আসছেন আপনারা।
ঠিক হলো পরবর্তি সাপ্তাহিক ছুটির দিন যাবে ওরা সবাই।

সেদিন রাতে এই স্বল্প পরিচিত আল্লারাখা আর তার মেয়ে অন্তরাকে নিয়ে অনেক সময় ধরে আলাপ করলেন নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী। দাওয়াতের ব্যপারে আল্লারাখার অমন আগ্রহের স্বরূপটা ঠিক বুঝলো না দুজনার কেউ।
আসলে এভাবে ওদেরকে বাড়ীতে ডাকার কারণটা অন্তরারও বোধগম্য হলো না।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.