অসহায় মানুষ -১৩ 

 

নাসিম নেওয়াজের আরো দুটো সন্তান আছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। কিন্তু চিরকাল প্রদিপ ওদের পরিবারের সবার কাছে অনন্য, সবার থেকে আলাদা।
বিয়ের পর প্রায় দশ এগারো বছর কোন বাচ্চা না হওয়াই জীবনটা ওদের প্রায় অর্থহীন হয়েই পড়েছিল। সব আশা ছেড়ে দিয়ে জীবনের হিসেব নিকেস গুটিয়ে নিয়ে সময় শেষ করার ভিতর যখন জীবনটাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিল তখনই আসলো প্রদিপ।
ও যেন এক যাদুকর। ওর যাদুর ছোয়াই সব পরিবর্তন হয়ে গেল রাতারাতি। নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগম প্রদিপকে পেয়ে জীবনের হিসেবের খাতাটা আবার নতুন করে খুললেন। বংশের প্রদিপটা ওকে হস্তান্তর করে চোখ বুজবেন সে আশায় ওর নাম রাখলেন প্রদিপ।
তায়তো তিন বছর পর ওদের দ্বিতীয় ছেলে জন্মগ্রহনের ব্যপারে তেমন কোন আগ্রহ ছিল না কারোরি। প্রদিপের পর আরো দুটো সন্তানের জন্ম ছিল সাধারণ ঘটনা মাত্র।
দীর্ঘ সময় ধরে অনাদরে বস্তিতে অবস্থান করার ফলে প্রদিপের শরীরটা একদম ভেঙ্গে পড়েছে। অসুস্থ ছেলেকে আদর করতে করতে সে সব কথায় ভাবছিলেন রেবেকা বেগম।

-বকুল সরদার বলে একজন মানুষ আছে ওখানে মা। সবাই তাকে সমীহ করে চলে। কত্তাবাবু বলে সম্মোধন করে। কারণ ওর একটা কারখানা আছে।
-কারখানার মালিক হলে বস্তিতে বাস করবে কেন?
প্রদিপের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে কিছুটা অবাক হয়ে কথাটা বললেন রেবেকা বেগম।
-হ্যে কারখানার মালিক তিনি। ওর কারখানায় শ্রমিকরাও কাজ করে।
রেবেকা বেগম তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে।
-তুমি ভাবছো অনেকটা বাবার মত তায়না?
মৃদু হেসে একটু থামলো প্রদিপ।
-তোমার ভাবনা একদম ঠিক মা। ওর ঘরটা বস্তির অন্যান্যদের ঘরের তুলনায় বড় আর মজবুত করে তৈরি। সে যে কেউ দেখলেই বুঝবে।
কিছুটা অন্যমনষ্কভাবে কথা বলছে প্রদিপ।
-জানো মা, একদিন সকালে সবাই কাজে বেরিয়ে গেলেও বকুল সরদার বের হয়নি। একটু অবাক লাগলো। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে ওর।
-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বকুল সরকার বললো যে ওর কারখানার শ্রমিকরা ষ্ট্রাইক করেছে।
নির্বাক হয়ে ছেলের কথা শুনছেন রেবেকা বেগম।
-আমার দিকে অমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম আমার কি কিছু করা দরকার। ওর যে দুজন কর্মচারী তাদের সাথে আমার জানাশোনা। ওরাও যে যার ঘরে শুয়ে আছে রাগ করে, কাজে যাবে না। ওদেরকে ডাকলাম আমি। দুটোই সমান একরোখা। বকুল সরদার রাগের মাথায় চড় থাপ্পড় কষে দিয়েছে এটাই ওদের অভিযোগ। কিছুতেই রাগ মিটবে না। শেষে আর কখনো মালিক ওদেরকে গাল মন্দ করবে না সে শর্তে মিটলো ওদের অভিযোগ।
-দুজন কর্মচারী! তা বকুল সরদারের কিসের কারখানা?
বেশ হালকা মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন রেবেকা বেগম।
-আখের রস বের করার ম্যশিন আছে তার।
মনে হলো একটু হাসলেন রেবেকা বেগম।
-ম্যশিনটা আগে ও নিজেই কাধে করে বয়ে নিয়ে বেড়াতো। এখন বয়স হওয়াই ম্যশিনটা কাধে বহন করার জন্য একজনকে রেখেছে ও। আর অন্যজন প্রতিদিন আশে পাশের গ্রাম থেকে তাজা আখ কিনে আনে।
প্রদিপকে কিছুটা অন্য মনস্ক দেখাল।
-অনেকটা পলাশের ঘটনা নিয়ে শ্রমিকরা যখন বাবার কারখানাটা বন্দ করে দিয়েছিল তখন বাবার চোখে মুখে যে উৎকণ্ঠা দেখেছিলাম ঠিক তেমনি উৎকণ্ঠায় ভরা ছিল সরদারের চোখ মুখ।
প্রদিপ অনেকটা স্বগত স্বরে কথা বলছিল। যেন নিজের সাথে কথা বলছে।
-বড় কোন কারখানার হাজার শ্রমিকের বিদ্রোহ আর আখের রস বের করা ক্ষুদ্র ম্যাসিনের দুজন শ্রমিকের বিদ্রোহ স্ব স্ব মালিকের মনে যে দুশ্চিন্তা আনে তার স্বরূপটা একই। প্রকৃতপক্ষে সবার জীবনের সুখ দুঃখ গুলোর পরিমাপ সমান শুধু কেবল আকার আকৃতিতে ভিন্নতা।

রেবেকা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মুখের উপর ভেষে ওঠা রেখাগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলেন।
প্রদিপ চিরকালই সবার থেকে আলাদা। তা জানেন রেবেকা বেগম। কিন্তু আজকে ছেলেকে কেমন যেন অপরিচিত লাগলো তার কাছে।
প্রদিপ যে কথাগুলো বলছে তার ভিতর অসংলগ্নতা নেই একটুও। আর ওর সব কথার পিছনে ওর প্রবল আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে।

সপ্তাহখানেক পর আল্লারাখা আসলো প্রদিপের শারীরিক অবস্থার খোজ খবর নিতে। এদিকে তার এই প্রথম আসা। কিন্তু তাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। নেওয়াজ বাড়ীর পুরোনো ড্রাইভার কাজলের সাথে রেল ষ্টেশানে দেখা। সেই তাকে গাড়ীতে করে বাড়ী পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

উচু পাচিল ঘেরা নেওয়াজ বাড়ী। নাসিম নেওয়াজ বাড়ীতে নেই জেনে রেবেকা বেগমকে ডাকতে চেয়েছিল কাজল। আল্লারাখাই নিষেধ করলো।
আল্লারাখাই অনুরোধ করলো নেওয়াজ সাহেব না আসা পর্যন্ত কাজলের বাড়ীতে বসবে।
প্রবল আপত্তি করলো কাজল। কিন্তু এক রকম জোর করেই ওর বাড়ীতে যেয়ে বসলো আল্লারাখা।
ঘন্টাখানেক পর নাসিম নেওয়াজ বাড়ী ফিরলে কাজল ওকে নিয়ে গেল বাড়ীর ভিতর।
আল্লারাখাকে দেখে খুব খুশী হয়ে অভ্যর্থনা করলেন নাসিম নেওয়াজ।
-কতোক্ষন এসেছেন?
জানতে চায়লো নাসিম নেওয়াজ।
-এইতো কিছুক্ষন হলো, আপনার বাগানটা চমৎকার, কাজলকে নিয়ে বাগানে পায়চারী করলাম একটু।
-বাসায় রেবেকা মানে প্রদিপের মা আছে কাজল বলেনি আপনাকে?
-বলেছিলো। ও নিয়ে কোন চিন্তা করার দরকার নেই নেওয়াজ সাহেব। আপনার বাগানটা খুব সুন্দর তায় ভাবলাম একটু ঘুরে দেখি। আর আপনার আসতে বেশী দেরী হলেতো এখই বাড়ীর ভেতরে যেতাম।
-তায় বলুন। আপনি আর আপনার মেয়ে মিলে প্রদিপের জন্য যা করেছেন সে ঋণ যে আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না।
-অমন কথা বলবেন না। প্রদিপের ও অবস্থায় যে কোন কেউ অতটুকু করতো।
কথা বলতে বলতে ড্রইং রূমে যেয়ে বসলো ওরা।
-অন্তরাই জোর করে পাঠিয়ে দিল প্রদিপের খোজ নেয়ার জন্য। ডাক্তারতো তায় বোধহয় অমন একজন রোগীর কি অবস্থা সেটা জানা বিশেষ দরকার।
-না না এটা শুধু রোগীর প্রতি ডাক্তারের কর্তব্য বোধই না, তার থেকে অনেক বড় কিছু। আদর্শ মেয়ে আপনার, দোয়া করি অনেক বড় হোক ও জীবনে।
ওরা কথা বলতে রেবেকা বেগম প্রবেশ করলেন।
-দেখ রেবেকা ছেলেকে দেখতে এসেছে অত দূর থেকে।
আল্লারাখাকে স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নাসিম নেওয়াজ।
-এক নজর দেখেই আবার রওয়ানা হবো। সন্ধ্যের আগেই ফিরতে হবে। মেয়েটা বাড়ীতে একদম একা।
রেবেকা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করে কথাটা বললো আল্লারাখা।
প্রদিপের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অভয় দিয়ে আল্লারাখাকে আশ্বস্থ করলেন নাসিম নেওয়াজ। তারপর ওকে প্রদিপের ঘরে নিয়ে গেলেন।
আল্লারাখার আসার খবর শুনে খুব ভালো লাগলো প্রদিপের। আল্লারাখাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো ও।
উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসলো প্রদিপ।
প্রদিপকে সেদিন ওই অবস্থায় দেখার পর আর বিশেষ করে ওর প্রতি বস্তিবাসীদের স্নেহ ভালবাসা দেখে আর গত কয়েকদিনে বস্তিবাসীদের কাছ থেকে ওর সম্পর্কে সবিস্তারে শুনে ওর সম্পর্কে মনে মনে একটা ছবি একেছিল আল্লারাখা।
আল্লারাখা আজ প্রদিপকে যেন নতুন করে দেখছে, ওর দিকে তাকিয়ে বাকরূদ্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষন। গভীরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে যেন নীরিক্ষা করছে ওর অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সবকিছু।
প্রদিপের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো সবাই। একটু অস্বস্থি বোধ করলো প্রদিপ।
-আপনি বসুন।
প্রদিপের কথায় যেন চমকে উঠলো আল্লারাখা। তাকালো পাশে দাড়ানো নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগমের দিকে।
-ঠিক আছে ঠিক আছে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো আল্লারাখা।
-আমরা সবাই রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তা এখন শরীর কেমন তোমার বাবা।
স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো আল্লারাখা।
-ভালো।
সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে ভালো করে খাটে হেলান দিল প্রদিপ।
-এনজিও’র কাজ ভালো ভাবে করার জন্য বস্তিতে থাকা, ঠিক আছে কিন্তু তায় বলে নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল নিতে হবে না।
আল্লারাখার উদ্বেগ প্রকাশে হালকা করে একটু হাসলো প্রদিপ।
-এতো কোন হাসির কথা নয় প্রদিপ।
মায়ের কথায় হাসি থামিয়ে প্রদিপ সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিল।
-আসলে ব্যপারটা কি জান মা। সেটা হচ্ছে কোন কিছু সম্পর্কে জানতে পারাটা। আমার শরীর খারাপের ব্যাপারে তোমরা জানার আগ পর্যন্ত সেটা ছিল এক রকম স্বাভাবিক ঘটনার মত মাত্র। কোন ঘটনা জানার পর মানুষ নিজের মত করে আবেগ তাড়িত হয়ে তার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। তাতে সমস্যা বরং বেড়ে যায়, কারন ঘটনাটি তখন তার নিচক গন্ডি পেরিয়ে অন্য সবাইকে জড়িয়ে ফেলে।
সবাই তাকিয়ে ওর মুখের দিকে।
-ভেবে দেখ এই আমাকে, সেদিন যদি ওরা অযথা ভয় পেয়ে ক্লিনিকে না নিয়ে গিয়ে ওখানে বিছানায় শুইয়ে মাথায় পানি দিত তারপর জ্ঞান ফিরলে কিছু খেতে দিত তাহলে আমি সেরে উঠতাম। আর এত সব কোন সমস্যা হতো না। অযথায় ব্যপারটা তোমরা জানতে পেরে সবাই এমন কষ্ট পেতে না।
সবাই তেমনি ভাবে তাকিয়ে ওর দিকে।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.