অসহায় মানুষ -১২ 

 

প্রদিপের কাছ থেকে টেলিফোনে সব জানতে পেয়ে পরদিন সকালে নাসিম নেওয়াজ নিজে কারখানায় গেলেন। কারখানার বন্ধ চাকা ঘুরতে দেখে তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাধা গলার সাথে ঝুলানো অবস্থায় সহাস্য বদনে বেরিয়ে আসলো প্রদিপ সাথে শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি সোলাইমান শেখ। তিনি জোড় হাত করে দাঁড়ালেন। প্রদিপের এ অবস্থার জন্য মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইলেন।
ছেলের অবস্থা দেখে নাসিম নেওয়াজের দুচোখ বয়ে অশ্রু বন্যা বাধ ভাঙল।
সেদিন প্রদিপ যে ভাবে নিজ উদ্যোগে ছোট ভাই, পুরো পরিবার আর ব্যবসাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাচিয়েছিল সে কথা পরিষ্কার মনে আছে নাসিম নেওয়াজ আর রেবেকা বেগমের। তায়তো ছেলের উপর ওদের বিশ্বাস এত প্রগাঢ়।
তাইতো ছেলের প্রতি অগাধ আস্থা আর মিঃ মিশেলের মন্তব্য ছেলেকে ওর কাজ থেকে বিরত করতে ওদের মন চায়নি সেদিন।

কিন্তু আজ আল্লারাখার বাসায় প্রদিপের শরীরের এ অবস্থা দেখে ওদের সে বিশ্বাসটা যেন নড়বড়ে হওয়ার উপক্রম হলো। -এ কয় দিনে একি অবস্থা হয়েছে ওর শরীরের! দেখলে একদম চেনা যায় না।

ছেলেকে বাসায় এনে ওর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করলেন নাসিম নেওয়াজ। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওর পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হলো।

চোখ বুজে শুয়ে প্রদিপ। রেবেকা বেগম হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ওর মাথায়।
নাসিম নেওয়াজ ঢুকলেন। স্বামীর সাথে চোখাচোখি হলো। বেরিয়ে আসলো নাসিম নেওয়াজ।
একটু বাদে রেবেকা বেগমও বেরিয়ে আসলো।
ব্যলকনিতে স্বামীর পাশে বসলো সোফাতে।
-ওকে বস্তি থেকে নিয়ে আসার সময় বস্তির মানুষনাকি ভীষণ আপত্তি করেছিল। ওরা প্রদিপকে আসতে দিতে চায়নি।
স্বামীর কথায় তার দিকে তাকালো রেবেকা বেগম।

বস্তি থেকে প্রদিপেকে আনার সময় বস্তিবাসীদের আপত্তির কথা অন্তরা সবিস্তারে বলেছে নাসিম নেওয়াজকে চা খাওয়ার সময়।
-এ অবস্থায় প্রদিপকে না আনার জন্য খুব জোরাজোরি আর অনুরোধ করেছিল বস্তিবাসীরা, কয়েকজন রীতিমত পথ আগলে দাড়িয়েছিল। ওকে বস্তি থেকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য এক বৃদ্ধা এসে আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটিও করলো।
অন্তরার কথায় বাকরূদ্ধ নাসিম নেওয়াজ।
-মনে হলো প্রদিপ ওই বস্তির প্রতিটি পরিবারের সাথে মিশে ওদেরই একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল।
চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল অন্তরা।
-বস্তির মানুষগুলো কিছুতেই প্রদিপেকে নিয়ে যেতে দেবে না। কিন্তু ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে ওকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া দরকার। প্রদিপের শারীরিক অবস্থা দেখে বাবাই জোর দিয়ে আমাকে বললো কোন ক্রমেই বস্তিবাসীর কথা শোনা ঠিক হবে না।
অন্তরার কাছ থেকে শোনা ঘটনার বর্ণনা স্বামীর কাছে শুনতে শুনতে যেন বাকরূদ্ধ হয়ে রইলো রেবেকা বেগম।
-বস্তিবাসীরা যদি ওকে অত ভালোই বাসে তাহলেতো ওর শরীরের ওই অবস্থায় ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেয়ার কথা।
স্ত্রীর প্রশ্নে নাসিম নেওয়াজ তাকালেন তার মুখের দিকে।
-প্রশ্নটা আমিও করেছিলাম অন্তরাকে। কিন্তু মনে হলো উত্তরটা ও যেন এড়িয়ে গেল। প্রশ্নটা বোধহয় ওর নিজেরও।
নাসিম নেওয়াজ তাকালেন স্ত্রীর চোখের দিকে।
কেমন যেন একটু অন্যমনষ্ক দুজনেই। নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী বসে রইলেন একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
অতীতের কোন ভাবনায় ডুবে গেল ওরা।

ছেলের এ অবস্থা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেয়ে কয়েকদিন পর নাসিম জোয়ারদার গেলেন মিসেলের সাথে কথা বলতে।
অফিস কমপ্লেক্সের ভিতর একটা বাসায় মিসেল বাস করে। একাই থাকে, ওর আপন কেউ নেই এখানে। এনজিও’র কাজে নিবেদিত এক প্রাণ। ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ‘মেডসাঁ সঅ ফনতিয়েঘ’ এর সাথে তার এনজিও’র একটা যোগাযোগ আছে। এদেশ থেকে অনেক বস্তিবাসী ছেলে মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্স সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠায় আর অন্যান্যদের যথাসম্ভব প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের বিভিন্ন জাইগায় কাজের ব্যবস্থা করে।
প্রদিপের সুপারিশ অনুযায়ী রাজধানি বস্তি থেকেও অনেকগুলো ছেলে মেয়েকে ইতিমধ্যেই বিদেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানালো মিসেল।
আরো বেশ কিছু সংখ্যক যুবক বস্তিবাসীকে তাড়াতাড়ি বাছাই করার জন্য প্রদিপকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এ কাজে বেশ সময় নিচ্ছিল প্রদিপ। আর কাজ শেষ না করতে পারার কারণ দেখিয়ে ইদানিং মাঝে মধ্যেই প্রদিপকে বস্তিতে থাকতে হতো। বিষয়টা মিসেলের মনোপুত না হওয়াই প্রদিপকে জিজ্ঞেস করেছিল এ ব্যপারে।
ওদের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে না মিশলে অনেক তথ্য সঠিক ভাবে পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিল প্রদিপ।
বিদেশে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্য কয়েকজনকে বাছাই করার ব্যপারে সিলেকশানের জন্য ওকে তাড়া দিলে জবাবে প্রদিপ জানিয়েছিল যে- পাঠানো হবে মাত্র কয়েকজনকে অথচ যাওয়ার মত অনেক বেশী ছেলে মেয়ে থাকায় কাউকে বাদ দেয়া সমস্যা হচ্ছে।
-বস্তি ছেড়ে ওই সব উন্নত দেশে যাবে এমন স্বপ্ন বলতে গেলে সবাইকেই বিভোর করে ফেলেছে। কিন্তু কজনকেই বা পাঠাতে পারবো। বাকি সবাইকেতো বস্তিতেই থাকতে হবে। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নটা ওদের বস্তিজীবনের নিষ্কলুস শান্তিকে বাধাগ্রস্থ করে। নিজের যৎসামান্য অর্জনটুকুকেও ওরা তুচ্ছ ভাবতে শুরূ করে দিয়েছে।
প্রদিপ কথাগুলো বলেছিল মিসেলকে।
-প্রকৃত অর্থে ওদের যা আছে তা নিতান্তই তুচ্ছ। কিন্তু ওটাকে ঘিরেই ওরা স্বপ্ন দেখে বেচে থাকে। সে স্বপ্ন ভেঙে গেলে, নিজেদের যা কিছু আছে তা যে তুচ্ছ সেটা বুঝতে পারলে ওদেরকে আর বাচিয়ে রাখা যাবে না।
প্রদিপের এ ধরণের মন্তব্যে চুপ করে ছিল মিসেল।
-প্রদিপ ডরমেটারীতে ফেরা প্রায় ছেড়েই দিল। তালিকা তৈরীর কোন রিপোর্ট পাঠানোও বন্দ করলো।
এর মধ্যে বিশেষ কাজে প্রায় মাস খানেকের জন্য তাকে বাইরে যেতে হয়েছিল বলে জানালো মিসেল। ফিরে এসে জানলো এত দিনে প্রদিপ একবারও আসেনি ডরমিটারীতে আর সব ধরণের রিপোর্ট দেয়া বন্দ করে দিয়েছে।
এ কথা শুনেই বস্তিতে গিয়েছিলেন মিসেল প্রদিপকে দেখতে। তখনই শুনলেন দুদিন আগে অসুস্থ অবস্থায় প্রদিপকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা।
নাসিম নেওয়াজকে ঘটনাগুলো স্ববিস্তরে বর্ণনা করলেন মিসেল।
-মিঃ নেওয়াজ, আরো আশ্চার্যের ব্যপার হলো, তালিকা তৈরী করার পরিবর্তে প্রদিপ ওদের সাথে গভীর ভাবে মিশে ওদেরই একজনের মত করে থাকতো। আর অযথা লোভের বশবর্তী হয়ে বস্তি ছেড়ে না যাওয়ার জন্য উল্টো বোঝাতো বস্তিবাসীদেরকে।
-আর একটা কথা কি জানেন, ওকে বস্তি থেকে আনতে না দেয়ার জন্য প্রদিপ কিছু যুবক বস্তিবাসীকে বাধা দেয়ার জন্য বলে রেখেছিল।
কিছুটা অন্যমনস্ক কথাটা বললেন মিসেল। নাসিম নেওয়াজ চুপচাপ শুনেছিলেন মিসেলের কথা।

সপ্তাহ খানেক পর একটু সুস্থ হলো প্রদিপ। কিন্তু বেশী হাটাচলা করতে নিষেধ করলেন ডাক্তার।
একটু আধটু হাটাহাটি করতে চায়লে বাড়ীর ছাদে বা লনে অল্প সময়ের জন্য। বাইরে বেরূনো একদম নিষেধ।
-তোর একি হাল হয়েছে বাবা!
রেবেকা বেগম ছেলের মাথায় বুলাতে বুলাতে কাদতে লাগলেন।
প্রদিপ তাকালো ক্রন্দনরতা মায়ের দিকে।
ভাষা ভাষা সে দৃষ্টি, একদম গভীরতা নেই তাতে। মনে হচ্ছে ও যেন অন্যখানে, থেকেও নেই, ভাবছে অন্যকিছু।
ছেলেকে খুব হতবিহবল আর হৃতবুদ্ধি মনে হলো তার কাছে। ও যে কি খুজছে তা বোধহয় ও নিজেও জানে না।
ছেলের এ পরিবর্তনে অবাক হলেন তিনি।
-তোর কি হয়েছে বাবা আমাকে খুলে বল।
চোখ মুছলেন রেবেকা বেগম।
-বস্তিতে সবই ঠিক আছে মা কোথাও কোন সমস্যা নেই। পুখুরের পানি শুখিয়ে গেলে মানুষ চেষ্টা করে হয়তো তা পুরণ করতে পারে। কারণ পুখুরতো মানুষের তৈরী। কিন্তু সাগর বিধাতার তৈরী সেখানে যদি পানি কমে যায় তবে তা পুরণ করার প্রয়াস অযথা। যিনি তৈরী করেছেন তিনিই সব দায়ভার গ্রহন করবেন।
গভীর ভাবে একটা নিঃশ্বাস টেনে কথাগুলো বলে নিজেকে প্রকৃতিস্থ করল প্রদিপ।
দুজনেই চুপচাপ।
-সমস্যাটা শুধু আমাদের চিন্তা চেতনায়। বাইরে থেকে যা দেখা যায় তা ঠিক নয় মা।
নিরবতা ভাঙলো প্রদিপ।
-তুই কি বলচিস এ সব। তোর কথা যে কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা। থাক তোর কথা বলার দরকার নেই। চুপ করে ঘুমো এখন।
চুপ করলো প্রদিপ।
-জান মা সবই হচ্ছে ভালবাসা। ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়।
রেবেকা বেগম হতবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে।
-ওখানেও সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। ওদের হাসি কান্নাও আমাদের মতই। একটুও কমতি নেই। ওরাও স্বপ্ন দেখে মা।
-বাবা তোর কথা ঠিক। কিন্তু ওদের জীবনের নিরেট বাস্তবতা ওদের স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দেয়।
-ঠিকই বলেছ মা। কিন্তু মজার ব্যপার কি জান। যাদের সহ্য শক্তি কম তারা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কেউ বা ইন্দ্রিয়ের বাধন থেকে পুরোপুরি আবার কেউ বা আংশিক মুক্ত হয়ে সাধারণ বোধশক্তি হারিয়ে দিব্যি বেচে থাকে।
রেবেকা বেগম তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।
-ইন্দ্রিয়ের জানালাগুলো যদি সব বন্ধ হয়ে যায় তবে স্বপ্ন পুরণ হলো না ভাঙলো তাতে কিই বা আসে যায়। ওখানে কত মানুষ আছে যারা ইন্দ্রিয়ের সব জানালা বন্ধ করে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন।
মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো প্রদিপ। যেন নিজের সাথে হাসা।
-থাক ওসব নিয়ে তোকে অত চিন্তা করতে হবে না। ভাল হয়ে ওঠ আগে।
-আমিওতো সে কথায় বলছি মা।
বালিশটা খাটের পিছনে খাড়া করে হেলান দিয়ে বসলো প্রদিপ।
-ওদের জন্য কারোর কোন সাহায্যের দরকার নেই। সাহায্য ওদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখে। আমাদের মতই ওদের জীবনও সুখ দুঃখের ভিতর দিয়েই অতিবাহিত হচ্ছে। দিনের শেষে হিসেবটা একদম একরকম। সমস্যা হচ্ছে ওরা সাহায্যের জন্য নিজের নয় অন্যের দিকে চেয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত শক্তি সম্পর্কে ওদের ভিতর সচেনতা সৃষ্টি করতে হবে। অপরের উপর বা বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভরতার মনোভাব পরিহার করে তাদের দৃষ্টি নিজেদের দিকে দেয়ার জন্য অনুপ্রানিত করতে হবে।
রেবেকা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.