অসহায় মানুষ -১১ 

 

ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নাসিম নেওয়াজ আর তার স্ত্রী রেবেকা নেওয়াজের। তারা জানে প্রদিপ যেটা করে সেটা সঠিক ভাবে বোঝে ও কি করছে। তায়তো এনজিও’তে চাকরী নিয়ে বস্তিবাসীদের উপর থিসিস করার জন্য ডরমিটারীতে থাকা, বস্তিতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা, ওদের সাথে ওরকম ভাবে মেলামেশার ইত্যাদি ব্যপার ওরা সমর্থন না করলেও জোর আপত্তি করেনি কখনো।
ছোটকাল থেকেই প্রদিপ ওর চিন্তা ভাবনা ও কাজে একটু ব্যতিক্রমী। অন্য সবার মত নয়। বাড়ীর কাজের মানুষ, কারখানার শ্রমিক এদের সকলের সাথে প্রদিপের একটু অতিরিক্ত সখ্যতা। সেই ছোট কাল থেকেই প্রদিপের যখন কোন কাজ থাকতো না বা খেলাধুলাই মন বসতো না তখন ওকে হয় পাওয়া যাবে বাড়ীর রাধুনীর সাথে রান্নাঘরে বসে অথবা ড্রাইভারের সাথে গাড়ী ধোয়া মোছার কাজে ওদের কাজে কিছুটা জোর করে সাহায্য করছে।
একটু বড় হওয়ার পর থেকে প্রদিপ স্কুল ছুটির দিনে বাবার সাথে ওদের কারখানায় যাবেই আর শ্রমিকদের সাথে ও খুব সাছন্দে মেলামেশা করতো।
পাট থেকে কার্পেট সহ অনন্য পাটজাত দ্রব্য তৈরী করার ইন্ডাস্ট্রি ওদের। বাবা যখন অফিসের কাজ বা কারখানার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত প্রদিপ তখন বিভিন্ন শ্রমিকদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত।
এ ধরণের বন্ধুত্বের জন্য কোন বয়সের ভেদাভেদ ওর জন্য অন্তরায় নয়। কারখানার শ্রমিকরাও ওর সান্নিধ্যে সাচ্ছন্দ বোধ করে। এ রকম একটা অলিখিত বোঝাপড়ার জের ধরে শ্রমিকদের উপর প্রদিপ অধিকারের আধিপত্যও খাটাতো বিভিন্ন সময়ে। ওদের মধ্যে ছোট খাট কলহ বিবাদের মিমাংসা করে দিত। বিনা বাক্যে শ্রমিকরা সব সময় মেনে নিত ওর বিচার।
নাসিম নেওয়াজ প্রথম প্রথম একটু শঙ্কিত থাকলেও পরবর্তীতে এ নিয়ে আর ভাবতেন না। প্রদিপের আত্মসচেনতা সম্পর্কে তার অটুট বিশ্বাস ছিল।

একবার কারখানার মধ্যে গাড়ী চালানো শেখার সময় প্রদিপের তিন বছরের ছোট ভাই পলাশ এক শ্রমিকের দশ বছরের ছেলেকে হটাৎ করে গাড়ী চাপা দিল। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেল ছেলেটি।
এ ঘটনার জের ধরে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিল। শ্রমিকরা মালিকের ছেলের ফাসির দাবিতে মিল গেটে তালা ঝুলিয়ে সব কাজ বন্দ করে দিল।
অনুপায় হয়ে নাসিম নেওয়াজ পুলিশের আশ্রয় নিলেন। তাতে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করলো। পুলিশ কোন জবরদস্তি করলে মিলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দিল শ্রমিকেরা।
একদিকে কারখানা বন্দ অন্যদিকে ছেলে মানুষ হত্যার আসামী। কি করবেন এ পরিস্থিতিতে তা ভেবে পাচ্ছিলেন না নাসিম নেওয়াজ।
শ্রমিকরা কেস করলে পুলিশ পলাশকে গ্রেপ্তার করবে। আপাততঃ ওর গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পলাশকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নাসিম নেওয়াজ।
প্রদিপ তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ে।
পলাশ একদম ভেঙে পড়লো। যে কোন ব্যপারেই কোন কুলকিনারা করতে না পেরে সেই ছোটবেলার মত বড় ভায়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলো।
-ভাইয়া আমিতো ইচ্ছা করে ওকে গাড়ী চাপা দিইনি। এটা আমার একটা ভুল। আমি ইচ্ছা করে মারিনি ছেলেটাকে। এখন আমার কি হবে ভাইয়া?
একদম ভেঙে পড়লো পলাশ। রেবেকা বেগমও ছেলের এহেন অবস্থায় খুব ভেঙে পড়লেন।
ওদের পারিবারিক এ্যডভোকেট বাদশা মিয়া শ্রমিকদের সাথে কোন রকমে আপস করা ছাড়া কোন পথ নেই বলে জানালো।

তখন রাত প্রায় দশটা হবে। পলাশকে শান্তনা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো প্রদিপ। কাউকে কিছুই না বলার জন্য বললো পলাশকে।

মিল গেটে তালা ঝুলানো। ভিতরে বাশের লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে কয়েকজন যুবক বয়সের শ্রমিক।
গেটের সামনে গাড়ী দাড় করিয়ে ওদেরকে হাতের ঈশারাই ডাক দিল প্রদিপ।
ওরা পাশে রাখা লাঠিগুলো তুলে নিয়ে উঠে দাড়ালো।
ওদেরকে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখাল, কি করবে ঠিক করতে পারছিলো না।
গেটের আলোয় ওদের একজন বোধহয় চিনতে পারলো প্রদিপকে।
-আরে বড় সাহেব!
প্রহরী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল গেট খুলতে।
পিছন থেকে অন্য প্রহরী ওকে থামিয়ে বললো -বড় সাহেব হোক আর যে সাহেবই হোক গেট খুলবিনে কেউ।
গেট খুললো না তবে এগিয়ে এলো ওরা সবাই গেটের কাছে।
প্রদিপের দিকে তাকিয়ে ওদের কারোরি মধ্যে সেই আগের যুদ্ধংদেহী ভাব দেখা গেল না।
-বড়সাহেব, লেবার সেক্রেটারীর নিষেধ আছে গেট খোলার।
প্রদিপকে সালাম দিয়ে কিছুটা উদ্ধত কণ্ঠে বললো একজন।
-আমি সেক্রেটারী সোলায়মান চাচার সাথে কথা বলতে চায়।
প্রদিপের প্রস্তাবে তাকে গেটের বাইরে দাড় করিয়ে ওদের একজন ভিতরে গেল। সে কিছুক্ষন পর ফিরে প্রদিপকে ভিতরে আসার জন্য গেট খুলে দিল।

প্রদিপের মিল গেটে আসার খবরটা শ্রমিকদের মধ্যে রটে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। মালিক পক্ষের লোক গোপনে এসে সেক্রেটারীকে ধরে নিয়ে যেতে চায়, সাথে পুলিশও আছে বলে গুজব রটে গেল।
কিছু উত্তেজিত শ্রমিক লাঠি হাতে মারমুখি হয়ে ছুটে আসলো মিল গেটে। ওরা প্রদিপের উপর আক্রমন চালালো। গার্ড তিনজন প্রদিপকে রক্ষা করাতে ওদের নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আর মারামারি শুরু হল।
ক্ষিপ্ত শ্রমিকদের দুপক্ষের লাঠির আঘাতে বেশ কয়েকজনের শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হলো।
প্রদিপের ডানহাতে লাঠির আঘাত লাগলো।
ইতিমধ্যেই সেক্রেটারী সোলায়মান শেখ এসে হাজির হলো।
-জানোয়ারের দল করেচিস কি। তোরা বড় সাহেবের গায়ে হাত তুলেচিস!
ক্ষীপ্ত শ্রমিকেরা ততোক্ষনে শান্ত হয়েছে।
প্রদিপের ডান হাতের কনুয়ের নিচে হাড্ডির উপর লাঠির বাড়িটা পড়েছে। সবাই ওকে ধরাধরি করে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গেল। কম্পাউন্ডার তাড়াতাড়ি করে ক্ষত জায়গাটা ড্রেসিং করে ব্যন্ডেজ করে দিল।
শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই জড়ো হতে শুরূ করলো চিকিৎসা কেন্দ্রের কাছে। সোলায়মান শেখ ওদেরকে বড় সাহেবের সাথে এধরণের ব্যবহারের জন্য গালমন্দ করতে লাগলো। এ কাজ যারা করেছে তাদেরকে বড় সাহেবের পায়ে ধরে মাফ চায়তে বললো।
এরই মধ্যে ডান হাতাটা ব্যন্ডেজ বাধা অবস্থায় সাদা একটা কাপড় দিয়ে নিজের গলার সাথে ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসলো প্রদিপ।
দোষী শ্রমিকদের কেউ বেরিয়ে না আসায় বৃদ্ধ সোলায়মান শেখ প্রদিপকে কাছে পেয়ে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তিনি নিজেই ওর হাত চেপে ধরে মাফ চায়তে লাগলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো প্রদিপ।
বৃদ্ধ সোলায়মানকে ও ভাবে মাফ চায়তে দেখে একজন যুবক বয়সের শ্রমিক মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো ভিড়ের মধ্য থেকে। সে সোজা যেয়ে প্রদিপের দুপা জড়িয়ে ধরলো।
-আমাকে মাফ করে দেন বড় সাহেব আমি জেনে শুনে একাজ করিনি। ভুল হয়ে গেছে আমার।
-আরে করচিস কি কদম আলী ওঠ ওঠ। তুই আমাকে মারতে যাবি কেন?
ওকে চিনতে পেরে ওর নাম ধরে ডেকে কথাটা বললো প্রদিপ।
– বড় সাহেব, আমাকে যে শাস্তি আপনি দেন আমি তা মাথা পেতে নেব। আমার বড় ভুল হয়ে গিয়েছে।
কাদতে লাগলো কদম আলী।
-তোরতো একটা হাত ভাঙা জানতাম। তা ওই ভাঙা হাতের অত জোর। ভাল হাত হলে আজ আমার হাড্ডি গুড্ডিই বোধহয় ভেঙে ফেলতিস।
সবাই হেসে উঠলো প্রদিপের রশিকতায়।
পরিস্থিতি অনেক হালকা হলো।
-এখন বলি আমি কেন এসেছি।
সবাই তাকালো প্রদিপের দিকে।
-ভুল মানুষে করে, ভুল হয়ে যায় বলেই আমরা মানুষ। না হলে হয় আমরা ফেরেস্তা হতাম না হলে জানোয়ার।
সবাই তাকিয়ে ওর দিকে।
-তবে আমার ভায়ের ভুলটা অনেক বড়।
থামলো প্রদিপ।
কেউ কোন কথা বলছে না।
-পলাশের ভুলের কোন মাফ হয় না। তবুও আমি ওর বড় ভাই হয়ে দুহাত জোড় করে ওর হয়ে মাফ চাচ্ছি।
শ্রমিকদের কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বেরূচ্ছে না।
প্রদিপের কথায় সবাই অনুধাবন করলো যে এক্সিডেন্টটা সত্যিই একটা ভুল। কিন্তু মৃত শ্রমিকের অসুস্থ বাবা বেচারা কসিমুদ্দিনের জন্য সবাই খুবই ব্যথীত। আর এই অবস্থায় ওর চার পাচ বছরের ছেলেটার কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত সবাই।

-কসিমুদ্দিন কিছুটা বিকলাঙ্গ তাই রোজগারে অক্ষম। ওর দুটো ছেলে। ওর বউটা মারা গিয়েছে গত বছর। ওই ছেলেটার উপার্জনের উপর নির্ভর করতো ওর সংসার। এমনিতেই ও বড় দুখী তার উপর বড় ছেলেটা হারিয়ে ও এখন উম্মাদ প্রায়।
সোলায়মান শেখ বললো কথাগুলো।
-আমরা যদি কসিমুদ্দিনের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করি আর ছোট ছেলেটার দায়িত্ব গ্রহন করি। ছেলেটা থাকবে আমাদের বাড়ীতে ওর ভরণ পোষন আর পড়াশোনার দায়িত্ব সব আমাদের আর ওর নামে দশ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপজিট রাখা হবে। তারপর বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে ওই সিদ্ধান্ত নেবে সে টাকা দিয়ে কি করবে ও।
কেউ কোন কথা বললো না।
-ও না হয় আমার আরেকটা ভাই হয়েই থাকবে।
সামনে জড়ো হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল। হাত ঈশারা করে সোলায়মান শেখ থামালো ওদেরকে।
– কসিমুদ্দিন অনেকদিন থেকেই বিছানায়, আর বলতে গেলে এখন পুরোপুরি উম্মাদ। ওই বড় ছেলেটায় ওদের সংসারটা চালাতো। সবাই বুঝি যে পলাশ বাবাকে ওর অপরাধের জন্য ফাসিতে ঝুলালেও কসিমুদ্দিনের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না।
একটু থামলো সোলায়মান শেখ। তাকালো সবার দিকে।
কোন কথা বললো না কেউ।
-কসিমুদ্দিনতো বুঝবে না কিছুই। ওর হয়ে আমরা না হয় প্রস্তাবটা বিবেচনা করি।
উপস্থিত শ্রমিকদের ভিতর আবার গুঞ্জন শোনা গেল। তারপর এক এক করে সোলায়মান শেখের কথায় সাঈ দিল সবাই।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.