অসহায় মানুষ -৮

 

আল্লারাখা তরফদার পরিবারের সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সালাম তরফদারের সমবয়সী আল্লারাখা। তরফদারদের সাহায্য সহযোগীতায় বেশ একটু আধটু লেখাপড়াও শিখেছে ও। চেহারায় খেটে খাওয়া মানুষের ছাপ থাকলেও আচার আচরণে ভদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।
ছোটকাল থেকে একটু ডানপিঠে স্বভারের হলেও বিশ্বস্ত। তরফদারদের এদেশের সম্পত্তি আর তরফদার বাড়ী দেখাশোনা করার দায়িত্ব বলতে গেলে আল্লারাখার উপর।
এক বয়সী আর বিশ্বস্থ হওয়ার সুবাদে সালাম তরফদারের সাথে বিশেষ সখ্যতা আছে ওর। বছরে কমপক্ষে একবার সালাম তরফদার ওকে সিংগাপুর থেকে ঘুরিয়ে আনে।
আল্লারাখাকে মূলত সালাম তরফদারই বিয়ে দেয় ওদেরই এক চেনা জানা পরিবারে। দরীদ্র পরিবার হলেও ওর বউটা দেখতে সুন্দরী। যেমন গায়ের রং তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
গা গ্রামের পোশাক পরিচ্ছদে কালো ছিপছিপে চেহারায় আল্লারাখাকে বউয়ের পাশে চাক্ষুস বেমানান লাগে। ব্যপারটা অন্য মানুষের নজরে যতটা না পড়ে তার চেয়ে বেশী করে পড়ে আল্লারাখার নিজের চোখে।
বিয়ের পর আল্লারাখা যেন রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেল। এক কথায় যাকে বলা যায় বউ পাগল। অনেকে তা নিয়ে ঠাট্টা তামাসাও করলো। কিন্তু তাতে বরং ওর পাগলামীটা আরো বাড়তে লাগলো।

বউকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করে না আল্লারাখা। আর বলতে গেলে ওর বউকে পাচিল ঘেরা তরফদার মহলের বাইরে যাওয়া প্রায় বন্দই করে দিল।
ধীরে ধীরে একটা বিজাতীয় মানষিকতা ওর মনে বাসা বাধলো।
আল্লারাখা ওর স্ত্রী দোলনের কাছে খুটিয়ে খুটিয়ে ওর ছোট বেলার কথা, ওর ছেলে বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনদের কথা জিজ্ঞেস করতো।
গ্রামের অশিক্ষিত দিন মজুরের মেয়ে দোলন। স্বামীর আদর সোহাগে আপ্লুত থাকলেও স্বামীর প্রশ্নগুলো কেমন যেন ভাল লাগতো না ওর।
বাড়ীর আশে পাশে ওর বয়সী ছেলেদের সাথে ওর জানাশোনা ছিল কিনা। থাকলে কেমন সে জানাশোনা। আর বিশেষ করে ওর একই বয়সের চাচাতো ভাই জমির যে বিয়ের পর ওর সাথে এ বাড়ীতে এসেছিল তার সাথে ওর সম্পর্কের ব্যপারটা বারবার জানতে চায়তো আল্লারাখা।
প্রশ্নগুলোর প্রকৃত অর্থ আর ইংগিতটা প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরে ঠিকই বুঝতো দোলন। কিন্তু কি বলবে ও কেবল চুপ করে থাকতো।
তাতে বরং আল্লারাখার মনের অমুলক সন্দেহটা দিন দিন আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
শুধু স্ত্রীকে চার দেয়ালের মধ্যে রাখা নয়, আল্লারাখা নিজেও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ীর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল যাতে করে স্ত্রী দোলনকে চোখে চোখে রাখা যায়। তা না হলে যেন কেউ নিয়ে যাবে ওর রক্ষিত ধণ।
বিয়ের পর দোলনকে মাত্র একবার নিজে সাথে করে ওর বাপের বাড়ীতে নিয়ে একরাত থেকে আবার সাথে করে নিয়ে আসলো আল্লারাখা। তারপর থেকে বলতে গেলে দোলন বন্দি তরফদার মহলে।
বছর গড়াতে না গড়াতে সন্তান সম্ভাব্য হলো দোলন। এ ভাবেই দিন কাটতে লাগলো। এর ভিতর বাড়ীর বাইরে একবারের জন্যও যাওয়া হয়নি দোলনের।
হাফিয়ে উঠলো দোলন মা বাবাকে একটু দেখার জন্য।
জমির এলো একদিন। প্রায় দেড়বছর পর বাপের বাড়ীর মানুষ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল দোলন। ওকে পাশে বসিয়ে মা বাবা সহ বাড়ীর অন্যান্যরা কে কেমন আছে ইত্যাদি জানতে ব্যকুল হয়ে উঠলো দোলন।
ওরা যখন একান্তে এভাবে কথা বলছিলো তখন বাইরে থেকে আল্লারাখা এসে দাড়ালো ওদের পিছনে। কিন্তু আনন্দে উদ্বেলিত দুজনের কেউ তা খেয়াল করলো না।
ওকে বাবার বাড়ী থেকে ঘুরিয়ে আনার জন্য পীড়াপিড়ি করতে লাগলো দোলন। আর জামির ওকে ওর স্বামী আসলে তাকে বলে রাজী করাবে বলে স্বস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
এসব দেখে আল্লারাখা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। হাতে ধরা বাজারের থলেটা ছুড়ে ফেলে দপ দপ শব্দে পা ফেলতে ফেলতে ঘরে ঢুকে গেল।
সে শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে ওরা দুজন হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো।
জমিরকে দেখে আর জমিরের সাথে ওভাবে কথা বলতে দেখে যে আল্লারাখা ক্ষিপ্ত হয়েছে তা জমির না বুঝলেও দোলন বুঝলো।
ভারী রাগ হলো আজ স্বামীর উপর দোলনের। কিছুটা ভীত হয়ে বসে থাকা জমিরের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হলো ওর।
জমিরকে বসতে বলে ঘরে গেল দোলন।
খোলা জানালার পাশে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে আল্লারাখা।
কি বলবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারলো না দোলন।
-জমির এসেছে আমাকে দুদিনের জন্য নিয়ে যাবে বলে।
-ঠিক আছে যাও না, একেবারে যাও ওর সাথে।
ঘৃণা ঠিকরে পড়লো আল্লারাখার কণ্ঠ দিয়ে।
-আমি দেখে না ফেললে ওর কাজ সেরে ওতো চলে যেত।
-কি বলছো তুমি পাগলের মত।
-পাগল হলেতো তোমাদের ভালোই হতো। দেখতাম শুনতাম কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।
এধরণের মন্তব্যে খুব আহত হলো দোলন।
-এখন বুঝেছি প্রায়ই ও আসে তোর কাছে।
-চুপ করো।
প্রায় চেচিয়ে উঠলো দোলন।
-অনেক সহ্য করেছি আর না। তুই একেবারে চলে যা আমাকে ছেড়ে। তোর মুখ আর আমি দেখতে চায়না।
রাগে যেন জ্ঞানশুণ্য হয়ে উঠলো আল্লারাখা।
-তুমি কি বলছো তা কি তুমি জান। আমার পেটে যে তোমার সন্তান। কয়েকদিন পরেই যে বাবা হবে তুমি।
আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো আল্লারাখা। ও এখন দিকবিদিক জ্ঞানশুণ্য।
-গোপনে গোপনে পর পুরূষের সাথে মেলামেশা করবি আর এখন বলছিস পেটের সন্তান আমার।
এবারে একদম ভেঙে পড়লো দোলন। ও মাটিতে বসে পড়ে স্বামীর পা চেপে ধরলো।
-এ দুর্নাম আমাকে দিও না।
লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল পায়ে পড়া স্ত্রীকে।
মুখ থুবড়ে পড়ে কাদতে লাগলো দোলন।
-তোর রূপ আছে, যা তা বেচে খা যেয়ে। বাজারে লোকের অভাব হবে না।
রাগে গর গর করতে করতে বেরিয়ে গেল আল্লারাখা।

কি করবে এখন দোলন! কোথায় কার কাছে যাবে?
দরীদ্র বাবা মাকে এমুখ দেখাবে কিভাবে!
-চল দোলন গ্রামে চল।
জমিরের কথায় উঠে বসলো দোলন।
চোখ দুটো অশ্রুশিক্ত লাল টকটকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব অশিক্ষিত জমির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে।
ঠিক করলো বাড়ীতে যাবে না দোলন। রাজধানী শহরের বস্তিতে ওদের গায়ের কিছু লোকজন আছে সেখানে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো জমিরকে।
বিকালের ট্রেনে চড়ে বসলো জমির দোলনকে নিয়ে।

তরফদার ভবনের ফলোয়ারস কোয়াটারে এতকিছু ঘটে গেল তার কোন কানাকড়িও খোজই রাখে না সেলিনা।
বেশ কয়েকদিন ধরে আল্লারাখাকে না দেখে ডেকে পাঠালো ওকে।
খুব অন্যমনষ্ক লাগলো আল্লারাখাকে। বউ ভালো আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে কেবল মাথা নাড়লো।
ওকে দেখা যায় না কেন, বউয়ের সাথে ঝগড়া টগড়া হয়েছে কিনা জানতে চায়লো সেলিনা।
-না তেমন কিছু না।
-তবে কোথায় তোর বউ? দেখিনা বেশ কয়েকদিন।
-ও বাপের বাড়ী গিয়েছে। তেমনি গোমড়া মুখে উত্তর দিল আল্লারাখা।
একটু অবাক হলো সেলিনা ওর কথা শুনে। কারণ বউকে বাপের বাড়ী পাঠানো আর একাকী! যেন মিলাতে পারছিলো না সেলিনা। কিন্তু কথা বলতে আল্লারাখার মধ্যে অনীহা দেখে আর জিজ্ঞেস করলো না কিছু।
ভাবলো বিয়েতো প্রায় বছর দেড়েক হয়ে গিয়েছে তায় বউ নিয়ে পাগলামী বোধহয় শেষ হয়েছে। আর বউটাও সন্তান সম্ভবা তায় হয়তো মায়ের কাছে পাঠিয়েছে।
ধীরে ধীরে আল্লারাখার ব্যহ্যিক আচার আচরণও স্বাভাবিক হয়ে আসলো। পরিবর্তন যেটা সেটা ওর গাম্ভীর্যে। কয়েক মাসের মধ্যেই ওর পরিবর্তনটা সবার চোখে পড়লো। ওর শরীরের বয়সটাও যেন ধায় ধায় করে বেড়ে গেল কয়েক বছর।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.