অসহায় মানুষ – ৭ 

 

অন্তরার বাবা সালাম তরফদার, জমিদার বংশ ওদের। সমুদ্রতীরবর্তী মফোঃস্বল শহরে প্রায় পঞ্চাশ একর জমির জমির উপর নির্মিত পুরনো আমলের বিশাল জমিদার বাড়ীটি এখনো দাড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
জমিদারী প্রথা রহিত হওয়া পর থেকে সালাম তরফদারের দাদা সারাফত তরফদার জাহাজের ব্যবসা শুরূ করেন। সিঙ্গাপুরে ছিল ওদের মুল ব্যবসা। তিনি সেখানেই বাড়ী কিনে শেষ জীবনটা কাটিয়েছেন।
বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ার সুবাদে সালাম তরফদারের বাবা সেলিম তরফদার ওই ব্যবসার মালিক হন। এদেশের একটি মেয়েকে বিয়ে করলেও সংসারটা ওখানেই পাতেন। আর বাবার মত তারও দেশে ফেরা হলোনা।
সেলিম তরফদারের দুই ছেলে জামাল আর সালাম।
বড় ভাই জামাল যৌবনে লন্ডনে যান পড়াশোনার জন্য। পরে সেখানে ওদেশের নাগরিক এক বাঙালী পরিবারে বিয়ে করে লন্ডনেই থেকে যান। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ওদের। বর্তমানে পরিবার নিয়ে ওখানেই বসবাস করেন। ছোট ভাই সালামের সাথে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে আর কালেভদ্রে যাতায়াত আছে বাড়ীতে। তবে দেশের কোন বিষয়ে সেই অর্থে বলতে গেলে একদম খোজখবর রাখেন না।
সালাম তরফদার বাবার ব্যবসা ধরে রেখে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করলেও দেশ আর বাড়ীর সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখে। এটা বোধহয় বাবা সেলিম তরফদারের শেষ জীবনের ইচ্ছের প্রতিফলন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি ছেলেদেরকে দেশে ফেরার জন্য উৎসাহিত করতেন। ছোট ছেলে সালাম কাছে থাকার সুবাদে নিজের মনের ইচ্ছেটা বোধহয় ওর মনে গ্রথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিছুটা।
সেলিম তরফদার অকালে চলে গেলেন। ছোট ছেলেকে বিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ও পেলেন না। যদিও ছেলের জন্য পাত্রী তিনি নিজেই নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু কোন রকমে ব্যবসাটা বুঝিয়ে দিয়েই চোখ বুজলেন।
বাবার পছন্দ করা একই শহরে বসবাসকারী মামার মেয়ে সেলিনাকে বিয়ে করলেন সালাম তরফদার। বাবার ইচ্ছের কথা মনে করে সালাম তরফদার সেসময় সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন ব্যবসা গুটিয়ে পৈত্রিক ভিটায় ফিরে আসবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। স্ত্রী সেলিনাকেও সব বলেছিল সালাম।
সেলিনা অতি রক্ষনশীল মনোভাবা সম্পন্ন মেয়ে। মুলতঃ এদেশেরই অন্য দশ জন সাধারণ মেয়ের মানষিকতা নিয়ে বড় হয়েছে। পাচ ফুট ছয় ইঞ্চির মত লম্বা, ফর্সা রং, হালকা গড়নের টানা টানা দুটো চোখ আর সুচালো নাকে ওকে অনিন্দ সুন্দরী বলা যায়। স্ত্রীর রূপে সত্যিই মুগ্ধ সালাম। স্ত্রীর প্রতি আকর্ষন দেশে ফেরত আসার বাসনাটা যেন আরো তীব্র হয়ে উঠলো।
দেশে ফেরার ব্যপারে খুবই আগ্রহী সেলিনা।
ঠিক হলো প্রাথমিক ভাবে ওরা সংসারটা সিংগাপুরে শুরূ করবে কিন্তু ফিরে আসবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সেভাবেই বিয়ের পর পরই স্বামীর সাথে সিংগাপুর গেলো সেলিনা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে প্রথম দিন থেকেই জায়গাটা আর সেখানকার মানুষের চাল চলন কথাবার্তা একদম পছন্দ হলো না ওর। তবু অল্প কিছু দিনের ব্যপার ভেবে গুনে গুনে দিন কাটানোর মনোস্ত করলো সেলিনা।
সিংগাপুরের জীবন আর ওখানকার সামাজিকতার মধ্যেই জন্ম সালামের। মেলামেশা কথাবার্তা ইত্যাদি সেলিনার কাছে অসহ্য লাগলেও সালাম সে সবকিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

পার্টি বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে সেলিনার পানির মাছ ডাঙায় উঠার মত অবস্থা হয়। অনেক পার্টিতে সেলিনা মুখ গোমরা করে থেকে তার অপছন্দের কথা স্বামীকে বোঝাতে চায়। কিন্তু স্ত্রীর সৌন্দর্যে মশগুল সালামের চোখ তা এড়িয়ে যায়।
একদিন জন্মদিনের এক পার্টিতে ওর এক বান্ধবীর প্রতি সেলিনার রূঢ় ব্যবহার আহত করলো সালামকে।
অনু ওর নাম। বাঙালী বাবা মায়ের ঔরসে সিংগাপুরে জন্ম। সালামের ছোট বেলার বন্ধু। এক সাথে লেখাপড়া করেছে। বর্তমানে একটা সফটওয়ার প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। পোশাক পরিচ্ছদ এবং আচার ব্যবহারে পশ্চিমা ভাবধারা সুস্পষ্ট। বিয়ে করেনি তখনো।
-অনু আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন বলতে পার।
কথাটা বলে অনুকে সালাম তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
-আরে এ দেখছি হিন্দি ফিল্মের নায়িকাদের মত।
হেসে মন্তব্য করে অনু হাতটা বাড়ালো সেলিনার সাথে করমর্দন করার জন্য।
সেলিনা পাল্টা ওর হাতটা বাড়ালো না।
অনু অপ্রস্তুত হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। সালামও অপ্রস্তুত। দুজনেই ভাবলো সেলিনা বোধহয় করমর্দন করার অফারটা বোঝেনি।
-কি অনু আমার বউয়ের সৌন্দর্য্য দেখে ঘাবড়ে গেলিতো?
সালাম তাড়াতাড়ি সেলিনার ডান হাতটা ধরে অনু‘র হাতের সাথে মিলাতে মিলাতে কথা গুলো বললো।
-ভাগ্যিস আমাকে বিয়ে করিসনি। আমাকে বিয়ে করার পর যদি তোর বাবার পছন্দের এই পাত্রীকে দেখতিস তাহলে নিশ্চিত আমাকে ডিভোর্স করে একেই বিয়ে করতিস।
অনু‘র রশিকতায় সালাম আর অনু দুজনে মিলে খুব হাসাহাসি করলো।
সেলিনা একটি কথাও বললো না।
-আর তোর ট্যাগর সংগীতের কি অবস্থা। আমি সিয়র যে এখন তোর গান শোনানোর জন্য একজন উপযুক্ত শ্রোতা পেয়েচিস।
কোন জবাব দিল না সালাম।
পশ্চিমা মনোবৃত্তির হলেও রবিন্দ্র সংগীত দারূন পছন্দ অনু‘র। বলা যায় সালামকে ওর পছন্দের অন্যতম একটা কারণ সালামের রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া।
-সালামের গলায় ট্যগর সঙ! আহ সত্যিই বলছি সেলিনা তোমার জায়গাটা যদি আমি দখল করতে পারতাম!
-থাক না সে সব কথা।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়লো সালাম। কারণ ও জানে সেলিনা কোন ধরণের গান বাজনা বা সিনেমা একদম পছন্দ করে না।
সেলিনা ওদের রশিকতায় একটুও অংশ নিল না।
বিষয়টা লক্ষ্য করলো সালাম। আর তায় ওর ভুল ভাঙতে সে রাতে পার্টি থেকে ফিরে অনু‘র সাথে ওর সম্পর্কের পুরো ঘটনা খুলে বললো।

অনু‘র বাবা আমির সোহেল আর সালামের বাবা সেলিম তরফদার বিজনেস পার্টনার। দুজনের যৌবনটা কেটেছে একই সাথে। তারপর একত্রে ব্যবসা করেছে প্রায় পচিশ বছর ধরে।
আমির সোহেলের খুব ইচ্ছে ছিল বন্ধুর ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবে। সালাম আর অনুও পছন্দ করতো একে অপরকে।
সালামের ছোট বয়স থেকেই সেলিম তরফদার ছেলের মনে দেশ সম্পর্কে একটা আকর্ষন তৈরী করার চেষ্টা করতেন। বছরে অন্ততঃ একবার হলেও ছেলেকে নিয়ে দেশে যাবেনই। তাছাড়া বাঙালী সংস্কৃতির সাথে ছেলের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তিনি সবসময় তৎপর থাকতেন। ছেলেকে ওস্তাদ রেখে রবিন্দ্রসংগীত চর্চ্চা করাতেন। দেশে বাপ দাদার ভিটিতে ফেরত যাওয়ার জন্য নানাভাবে উৎসাহ যোগাতেন।
সেলিম তরফদারের মনের ইচ্ছাটা সেদিনই আরো পরিষ্কার হলো যেদিন অনুকে ওর ঘরের বউ করার জন্য বন্ধু আমির সোহেলের প্রস্তাবটা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলেন।

স্বামীর মুখে বর্ণনাটা শুনে কোন কিছুই বললো না সেলিনা।
প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো। তারপর একদিন সেলিনা স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিল যে কোন পার্টিতে আর যাবে না ও।
আহত হলো সালাম। সেলিনাকে আস্তে আস্তে কেমন যেন আবেগহীন মনে হতে লাগলো ওর কাছে। সালাম ধীরে ধীরে খেয়াল করলো যে স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক ভালবাসাবাসির ব্যপারে সেলিনা কখনোই স্বতঃস্ফূর্ত নয়। বিয়ে করা বউ যেহেতু সেহেতু স্বামীর ভালবাসা তার পাওনা এ ধরণের মনোভাব পোষন করে সেলিনা। তার তরফ থেকে অর্জনের কোন তাড়না সালাম লক্ষ করেনি কখনো।
বছর না গড়াতে গড়াতে সালামের পক্ষ থেকে একতরফা আবেগ প্রদর্শনেও ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে আসলো।
সালামও ব্যবসার কাজে নিজেকে আরো বেশী বেশী করে সম্পৃক্ত করতে লাগলো। এমন পরিস্থিতিতে সেলিনা নিজেকে আরো গুটিয়ে নিল এবং ধীরে ধীরে ধর্মীয় কাজে নিজেকে গভীর ভাবে ডুবিয়ে রাখতে শুরূ করলো।
এমন অবস্থায় সেলিনা দেশে ফিরে একাকী বসবাস করার প্রস্তাব দিলে সালাম কোন আপত্তি করলো না।

প্রায় এক বছরের মাথায় দেশে ফিরে আসলো সেলিনা।
প্রথম কিছুদিন বাবার বাড়ীতে কাটালো।
এভাবে বাবার বাড়ীতে থাকতে আত্ম সম্মানবোধে বাধায় সেলিনা বাবার বাড়ী ছেড়ে স্বামীর বাড়ীতেই অবস্থান করা শুরূ করলো।
বাড়ীতে থাকা খাওয়ার যেন কোন অসুবিধা না হয় তার সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করেছিলেন সালাম তরফদার। বিরাট বাড়ী, কাজের লোকজনেরও অভাব নেই। সেলিনাকে দেখাশোনা করার জন্য বাবার আমল থেকে তরফদার পরিবারের সাথে আজন্ম জড়িত আল্লারাখাকে বিশেষ ভাবে নির্দেশ দিল সালাম তরফদার।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.