অসহায় মানুষ -৫

 

বস্তি সরদারের দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে। মেয়ে দুটো বড় বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী মারা গিয়েছে অনেক বছর হলো। দুটো ঠেলা দোকান আছে সরদারের। নিজে বসতে পারে না তায় দুটো লোক রেখে চালায়।
রতন কোন রোজগার করে না। কি যে করে তাও কেউ জানে না। দেখেশুনে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিল সরদার, ভেবেছিল বিয়ে দিলে দায়িত্ব আসবে, ঘরলাগা হবে। প্রথম কিছুদিন ঠিক ছিল কিন্তু এখন আবার আগের মত। বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছে।
হাতের কোন কাজই ও জানে না।
-জান না ঠিক আছে তবে কোন ধরণের কাজ ভাল লাগে সেটা বলো?
প্রদিপ সম্পর্কে সন্দেহ দুর হওয়াই রতন ততোক্ষনে একটু স্বাভাবিক হয়েছে।
-ভাবে দেখে বলবো।
কিছুটা বিরিক্তির সুর তখনো ওর কণ্ঠে।
-বউ পেটানো কাজটাতো ভালই পার।
কথাটা বলে মৃদু হাসলো প্রদিপ।
লজ্জায় নিজেকে একটু গুটিয়ে নিল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাধুকরী।
-ওকে কি আর সাধ করে মারি।
-তবে?
এতোক্ষনে বেশ খোলামেলা হয়েছে সবাই কথাবার্তায়।
-পনরো দিন পর আজ ভোর বেলা এয়েচি, ঘুম নেই খাওয়া নেই। বল্লাম কিছু একটা দে তাড়াতাড়ি করে খায়ে ঘুমোবো। চোখ দুডো খুলে রাখতে পাচ্চি না একদম।
পরিষ্কার ভাবে কথা বললেও ঘুম ঘুম ভাব তখনও রতনের চোখে। মাঝে মাঝে হাই তুলে নিচ্ছে।
-হে বলে কি জানেন- হেরও নাকি ঘুম পাচ্ছে, আমার সাথে ভোরের ঘুমটা একটু ঘুমোয় নিয়ে তারপর আমার দেবে। কি আবদার, সারারাত ঘুমোয়ে এখন আমাকে দেখে ওরও ঘুম পাচ্ছে। রাগ না উঠে পারে।
প্রদিপ তাকালো মাধুকরীর দিকে। ও লজ্জা পেয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতে চায়লো। গোটা গোটা চোখ দুটোতে সদ্য লাগানো কাজল চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ধুয়ে তার কিছু অংশ লেপটে আছে ওর তুলতুলে দু’চোয়ালে।
হায়রে নিয়তি শিউলি পূর্ণ পরিস্ফুটিত হয়ে সারারাত গন্ধ ছড়িয়ে ভ্রমরের অপেক্ষা করল আর ভোর রাতে সূর্যের প্রথম আলোতে ভ্রমর আসার আগেই এক ফোঁটা শিশিরের আঘাতে বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইলো।
-হেরে একটা কাজ দেন আপনি, যাতে রাত বিরাত বাইরি বাইরি থাকতি না হয়।
মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিয়ে কথাটা বলে ভিতরে চলে গেল মাধুকরী।
একই ধরণের অনুরোধ সরদারও করলো প্রদিপকে।
-পুলিশির পিটানি খায়ে মাঝে মধ্যে যহন আসে ওর অবস্থা দেইখা আমার আর সহ্যি হয় না। প্রায় প্রায়ই ওরে মারধোর করে পুলিশ থানায় দিয়ে আটকে রাখে পরে ওর কোন সাহেব ওকে ছাড়িয়ে আনে।
পাশের ঘর থেকে শশুরের কথা শুনে একটু বাদেই কাদতে কাদতে মাধুকরী আবার ফিরে আসলো সে ঘরে।
খাটে হেলান দিয়ে থাকা রতনের ডান হাতটা টান দিয়ে বের করে ওর একটা আঙ্গুল দেখিয়ে বললো -দেহেন গত মাসে পুলিশ মারে ওর আঙ্গুলটা ভাঙে দিয়েছে।
শব্দ করে কাদতে লাগলো মাধুকরী।
-হের শরীলে মারনের আয় জাগা নেই। মার খাইতে খাইতে সারা শরীরে বিষ করে।
শাড়ীর আচলে চোখ দুটো মুছতে লাগলো মাধুকরী।
সরদারও ঘাড়ের গামছার কোনা দিয়ে চোখদুটো মুছে নিল।
রতনের চোখদুটোও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।

ধীরে ধীরে সরদারের পরিবার বিশেষ করে মাধুকরীর সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠলো প্রদিপের। মাধুকরীর মধ্যে এক ধরণের অদম্য আকর্ষণ আছে। ও যা কিছু ভাবে বা বলতে চায় তার সব ওর চোখ মুখে আর অঙ্গে পরিষ্কার প্রতিভাত হয়ে ওঠে। অন্য সবার মধ্যে দুটো আলাদা সত্ত্বা বিরাজ করে কিন্তু মাধুকরী একদম আলাদা। মাধুকরীকে খুব ভাল লাগে প্রদিপের, ওর সরলতার জন্য। ছল চাতুরীতে ভরা এই দুনিয়াই মাধুরী যেন এক সরলতা দ্বীপ। ওর কাছে বসে কথা বলার মধ্যে অন্যরকম একটা স্বাদ পাই প্রদিপ।
নিরক্ষর মাধুকরী, জ্ঞান বলতে কেবল শাক ভাত রান্না করা আর স্বামী শশুরের সেবার মধ্যেই সীমিত। কোন গভীরতা নেই চিন্তা চেতনায়। ওর যা কিছু আছে তার সব ওর ওপরে, সারা অঙ্গ জুড়ে। সেটাকেই প্রাধান্য দিয়ে বিধাতার ওই ঈন্দ্রিয় তৃপ্তিদায়ক দানকেই মুখ্য বিবেচনা করে ওর সান্নিধ্য লাভের ভিতর যেন অর্থ খোজার চেষ্টা করে প্রদিপ।

বেশ কয়েকদিন ধরে ভিষণ ঝড় বৃষ্টি, থামার কোন লক্ষণই যেন নেই। গত প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে জ্বর প্রদিপের। তবুও কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি না।
সন্ধ্যা হতে না হতেই অধিকাংশ বস্তিবাসীরা ঘুমিয়ে পড়েছে নিত্য দিনের মত। কাজ শেষে প্রদিপ অধিকাংশ দিন ডরমিটারিতে ফেরে না বস্তিতেই থেকে যায়। অন্যান্যদের ঘরে মাঝে মধ্যে রাত কাটালেও সরদারের ঘরেই বেশী থাকে প্রদিপ। এবার জ্বর হওয়ার পর থেকেই প্রদিপ সরদারের ঘরে।
বেশ ঠান্ডা পড়ছে। সন্ধ্যা হতেই ওর শরীরে জ্বর বাড়তে লাগলো। কিছু হবে না বলে পাত্তা দিতে না চায়লেও তাপ বেড়েই চললো। আর সন্ধ্যেটা ধরে আসার আগেই জ্বরের প্রকোপে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাতে লাগলো প্রদিপ।
সরদার ঘরেই ছিল। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না কেউ।
হটাৎ করে কাউকে কিছু না বলে মাধুকরী ওই বৃষ্টির মধ্যেই প্রদিপকে অজ্ঞান অবস্থায় আড়কোলা করে বস্তির ক্লিনিকে নিয়ে গেল।
সাধারণত সন্ধ্যার আগেই ক্লিনিক বন্দ হয়ে যায়। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির জন্য তখনও খোলা ছিল সেদিন ওটা।
ক্লিনিকটা সরকারী। একজন ডাক্তারও নিয়োগ দেয়া আছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রায়ই তিনি অনুপস্থিত থাকেন। বৃদ্ধ এক বস্তিবাসী কম্পাউন্ডার সময়মত ওটা খোলে আর বন্দ করে।
সদ্য ডাক্তারী পাশ করা এক তরূনী অন্তরা তরফদার এখানে প্রায় প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে এসে বসে। ভলেনটারী সেবা প্রদান করে। দরদ দিয়ে রূগী দেখে সন্ধ্যে অব্দি।
পড়াশোনার চাপ থাকায় আগে মাঝে মধ্যে কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই আসতো। কিছুদিন হলো ইনটার্ণশীপ শেষ করার পর থেকে নিয়মিত ভাবে এ কাজ শুরূ করেছে অন্তরা।
বস্তির সবার সাথে মোটামুটি পরিচয় হয়েছে ইতিমধ্যেই। সবাই ওকে ডাক্তার আপা বলে সম্বোধন করে।

মুলত আল্লারাখার অনুরোধেই এই কাজটা শুরূ করছে অন্তরা।
-মা ক্লাসের পর বাসায় এসে বসেইতো থাকিস। তা চলনা তোকে নিয়ে যায় একখানে। দৈনগ্রস্থ মানুষের সেবার সমুদ্র সম ক্ষেত্র ওটা।
আল্লারাখার যাতায়াত রাজধানি বস্তিতে অনেকদিন ধরে তা জানে অন্তরা। কিন্তু কারণটা জানে না। জানতে ইচ্ছে হয়েছে কখনো কখনো। কিন্তু চিরদুখী এই মানুষটার দুঃখ পাছে আবার বেড়ে যায় সে আশঙ্কায় জিজ্ঞেস করিনি কখনো।
বাবার মত এই বৃদ্ধ আল্লারাখার প্রস্তাবে রাজি হলো অন্তরা। এখানকার সরকারী ডাক্তারও বিনা দ্বিধায় সাঈ দিল আল্লারাখার প্রস্তাবে।
মুল শহর থেকে প্রায় দশ কিঃ মিঃ দুরে মিল কারখানা এলাকায় অবস্থিত বস্তিটা। শহরে ঢোকার রাস্তার নিকটেই অবস্থিত। নিজের গাড়ীতে কারে বাসা থেকে বস্তিতে পৌছাতে সব মিলে এক ঘন্টার একটু কম সময় লাগে।
প্রথম প্রথম একটু জড়তা থাকলেও অল্প দিনেই তা কাটিয়ে উঠে এখন খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে অন্তরা।
পড়াশোনা শেষ করার আগে ক্লিনিকে আসাটা একটু অনিয়মিত থাকলেও এখন যেন এখানে আসা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ওর। আল্লারাখাও সাথে আসে। অনেকদিন কোন কারণে আল্লারাখার আসতে দেরী হলেও অন্তরার রূটিনের একটুও হেরফের হয় না।

সেদিন বিকেল থেকেই ফিস ফিস করে বৃষ্টি হচ্ছিলো গত কয়েক দিনের মত। আর রূগীর সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে এ কদিনে। রূগী দেখা শেষ করতে করতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল।
অচেতন প্রদিপকে কোলে করে এনে ক্লিনিকের খাটে গুইয়ে দিল বিশাল দেহের অধিকারী বস্তির এক মহিলা। সাথে আসলো কিছু বস্তিবাসী।
অনেক জ্বর ওর গায়ে। থারমমিটার দিয়ে মেপে দেখলো ১০৪ ডিগ্রির উপর। ব্যস্ত হয়ে উঠলো অন্তরা। বৃদ্ধ কম্পাউন্ডারকে পানি আনার ব্যবস্থা করতে বললো। প্রদিপকে নিয়ে আসা বস্তিবাসীকে পরিস্কার কোন নরম কাপড় বা গামছা আনতে বললো।
-ওর সারা শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে স্পঞ্জ করতে হবে আর মাথায় পানি ঢালতে হবে। জ্বর কমাতে না পারলে ওর জ্ঞান ফিরবে না।
অন্তরার কথায় উপস্থিত কয়েকজন বস্তিবাসী তাড়াতাড়ি করে সব জোগাড় করার কাজে লেগে গেল।
কিছুতেই জ্বর নামানো যাচ্ছে না, ওকে বরফ পানি দিয়ে গা স্পঞ্জ করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তেমন কোন ব্যবস্থা এখানে নেই।
ওকে নিয়ে আসা সুঠাম দেহের অধিকারী মহিলাটি জানালো গত প্রায় তিন চার দিন যাবতই ওর জ্বর চলছে। ওরা সাধ্যমত সব কিছুই করেছে কিন্তু জ্বর কমাতে পারিনি।
-আগে ডাক্তার খানায় আনোনি কেন?
-হে কি কারো কথা শোনে।
সুঠাম দেহের মহিলার জবাব শুনে ওর দিকে তাকালো অন্তরা।
-আজও জ্ঞান থাকলে ওকে আনন যাইতো নাকি।
ক্লিনিকের সল্প আলোতে দেখা যাওয়া অন্তরার চোখে চোখ রেখেই কথাটা বললো বিশাল দেহের মহিলাটি।
রোগীর আপন কেউ হবে ভাবলো অন্তরা। তবে জ্ঞান থাকা অবস্থায় ওকে কেন আনা যায়নি কেন সেটা ঠিক বুঝলো না।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.