অসহায় মানুষ -৪

 

দিন পনের আগে বিশ বছরের বস্তির একটা ছেলেকে প্রদিপের সুপারিশে বিদেশে পাঠানো হলো। শিমুল ওর নাম। পঙ্গু মায়ের এক মাত্র ছেলে ও। চুড়ী ফিতা ফেরী করে দিব্যি শান্তিতে ছিল ওরা।
শিমুলকে বিদেশে পাঠানোর জন্য যখন নির্বাচন করা হলো তখন খুশীতে ডগমগ ওরা। ওর পঙ্গু মা প্রদিপকে ওর জানা সব কথা দিয়ে দোয়া করলো। বছর খানেকের জন্য যাচ্ছে শিমুল। ওর মা চালিয়ে নেবে কোন রকমে। ওর অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশীরা পঙ্গু মাকে সাহায্য করবে বলে অভয় দিল শিমুলকে।
আনন্দাশ্রুতে বুক ভাষিয়ে বিদায় নিল শিমুল।
শিমুল চলে যাওয়ার বিশ দিনের মাথায় মরে গেল শিমুলের মা। প্রদিপ পরে খোজ নিয়ে জানলো বলতে গেলে না খেতে পেরে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে ওর মা।
অশ্রুতে ভরে গেল প্রদিপের দুটো চোখ। মুরব্বি দুএকজন এগিয়ে এসে বললো, শিমুলকে যেন খবরটা না দেয়া হয় তাহলে বেচারা বুক ফেটে মরে যাবে। ভারি অসহায় লাগলো নিজেকে।
এত বড় একটা সত্য মিসেলের কাছ থেকেও চেপে রাখলো প্রদিপ। নিজেকে বুঝালো যে আরো একটা খুনের দায় ও বহন করতে পারবে না। মনে পড়লো হাসি খুশী ভরা তুচ্ছে তুষ্ট শিমুল আর ওর মায়ের বস্তির জীর্ণ ঘরের জীবনটা।
ওদের অনাবিল শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাবার কোন অধিকার কারো নেই। ভাবলো প্রদিপ।
এখানে কাজ করতে এসে জীবন সম্পর্কে ধারণাটায় পাল্টে যেতে লাগলো প্রদিপের। এখানকার মানুষগুলো বেচে থাকার জন্য পুরোপুরিই নির্ভরশীল ওই আলো ঝকমকে সভ্য জগতের মানুষদের উপর। ওদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার এরা। ওদের দেখা যাওয়া যত চাকচিক্য আর পরিচ্ছন্নতা তা সবকিছুই এদের অবদান। অথচ এরা বাস করে পচা দুর্গন্ধময় অমানবিক পরিবেশে।
সভ্য সমাজের মানুষগুলোর চাকচিক্যের পিছনের প্রতিটি ইতিহাস যেমন এদের জানা তেমনি ওই সাদা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখা সব পৈশাচিক কাজকর্মের হাতিয়ারও এই বস্তি বাসী।
এখানে কাজ করতে এসে প্রদিপ যেন এক অজানা অতল ভুবনের সন্ধান পেয়েছে।
অজানা গন্তব্যে যাত্রার প্রতি আজন্ম আকর্ষন আছে প্রদিপের ভিতর। আর তায় এখানকার জীবন অন্বেষণ করার এক অদম্য নেষা ওর উপর ভর করলো।
অফিসের দেয়া ফরমেটের ঘর পুরো করার জন্য গদবাধা তথ্য সংগ্রহ করেই ওর কাজ শেষ হয় না। এখানকার প্রতিটি মানুষের ফেলে আসা জীবন আর এদের জীবনের কেউ না দেখা গল্পগুলো জানার একটা অদমনীয় ইচ্ছা ওকে সারাক্ষন তাড়া করে ফিরলো।
আর তায় অফিসের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যেই ওর দিন শেষ হয় না। প্রদিপ প্রতিদিন বস্তিতে সময় কাটায় অনেক রাত পর্যন্ত। কথা বলে ওখানকার মানুষদের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে।
বস্তিবাসীদের এক একটা জীবন এক একটা নিরেট বাস্তবে ভরা। যেন বইয়ের পাতায় লেখা গল্প। তবে গদবাধা গল্পের মত নয়। এদের জীবনের গল্পের কোন আনুষ্ঠানিক শুরূ নেই। নিজের মতই শুরূ হয়ে এগিয়ে চলেছে। জীবন যে এগোচ্ছে তা এরা অনুভব করে প্রতি পলকে। দিন এমনকি ঘন্টা গুনে গুনে বেচে থাকে এরা। যুদ্ধ করে চলতে হয় আর হিসেব করে নিতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপ।
শুরূ কোথায় বা কি ভাবে হয়েছিল তার খোজ এরা রাখে না। আর শেষ কোথায় হবে তার জন্যও চিন্তিত নয় কেউ। আর শেষ যে একদিন হবে তাও এরা বোধহয় ভুলে গিয়েছে।
এরা সবাই বেচে আছে যায় দিনের হিসেব নিয়ে।
সকালের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়ে সবাই জীবিকার প্রয়োজনে। সন্ধ্যে হলে সবাই ফিরতে থাকে ধীরে ধীরে। সে সময়টায় পাওয়া যায় এদের।
মশা মাছি তেলাপোকা আর রূগ্ন কুকুরের সাথে সহবস্থান এখানকার মানুষগুলোর।
প্রদিপ তায় বিকেল থেকেই শুরূ করে ওর কাজ।
এতদিনে প্রায় প্রতিটি ঘর আর মানুষের সাথে ওর জানাশোনা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করতে করতে প্রদিপ এই বর্তমানকে নিয়ে বেচে থাকা মানুষ গুলোর নিত্যদিনের সাথি হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যের পর কেরোসিনের কুপী জ্বালিয়ে তেল চিটচিটে তাস দিয়ে খেলা থেকে গুরূ করে রেডিও ঘিরে বসে ফিল্মের গান শোনা সব কিছুতেই অংশ গ্রহন করে ওদের সব ধরণের সুখ দুঃখের সাথি হয় প্রদিপ।
প্রায় দিনই বেশী রাত হয়ে যায় আর ফেরা হয় না ঝকঝকে তকতকে ডরমিটারীতে। বাস্তিতেই রাত কাটিয়ে দেয়।
না ফিরতে ফিরতে ইচ্ছে হয় না আর ফেরার। ধীরে ধীরে বস্তিতে থাকতে শুরূ করে প্রদিপ।
প্রদিপের চিন্তা চেতনা কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যেতে থাকে। এসব ভাবনা কেমন যেন দিকভ্রান্ত করে ফেলে ওকে। ওর এত দিনকার ভাবনার সব কিছু ভ্রান্তি মনে হয়। মনে হয় মানুষের ওপর দেখে ভেতর বোঝা অসম্ভব। ওপর আর ভেতর দুটো আলাদা আলাদা জগত। মানুষের ভেতরের জগতের স্বরূপ জানা সম্ভব নয়।
আজকাল নিজের কাছে নিজেকেও অচেনা লাগতে থাকে প্রদিপের। তায়তো নিজের ভেতরটাকেকে পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবল ওপরটা নিয়েই বেচে থাকতে ইচ্ছে হয় ওর।
যা কিছু অতীত তাতো অতীতই। যা কিছু ভবিষ্যত তার সব টুকুই অনিশ্চিত। শুধু বর্তমানটায় সত্য। এটা দেখা যায় ছোয়া যায় স্বাদ নেয়া যায়। বাচার জন্য কেবল এটাই মুখ্য, অন্য সবই গৌণ।
ও যেন ডুবন্ত এক নৌকার যাত্রী। অনেক ফুটো হয়ে গেছে নৌকাটাতে। ফুটোর সংখ্যা দিন দিন কেবল বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য ভাবে। তা ঠেকানোর শক্তি ওর নেই। আর অনেক দেরীও হয়ে গিয়েছে। কি করে কোথা থেকে শুরূ হলো ফুটোগুলো তা চিন্তা করে কি লাভ। কখন ডুববে বা ডুবার পর কি হবে সে সব চিন্তা করে নাকে মুখে ঢুকতে থাকা পানিতো আর কমানো যাবে না। তার থেকে বরং হাতের পাশে দৃশ্যমান খড় খুটো যা পাওয়া যায় সেটাই আকড়িয়ে এই মুহুর্তটুকু কাটানোর একটা বন্দোবস্ত করাই শ্রেয়।

এমনই সময় প্রদিপের সাথে পরিচয় হলো বস্তিবাসী মাধুকরীর।
বস্তি সরদারের ছেলে রতনের স্ত্রী ও।
সরদারের ছেলেটা পুরোপুরি মদ্যপ। মার দাঙ্গার মধ্যেই সময় কাটে ওর। পুলিশের খাতায় নাম আছে। বাড়ীতে থাকে না খুব একটা বাইরে বাইরে রাত কাটায়। বাবার শাসনের একদম বাইরে।
মাঝে মধ্যে বাড়ী আসলে কারণে অকারণে পেটায় বউটাকে। বাড়ীর কেউ ভয়ে রতনের কোন কাজের প্রতিবাদ করে না।
বস্তি সরদার একদিন সকালে প্রদিপকে নিয়ে গেল তার বাড়ীতে।
ভিতরে রতনের অসংলগ্ন ভাষায় চেচামেচি আর মার খেয়ে ওর বউটার কান্না শুনে- কি হচ্ছে প্রদিপ জিজ্ঞেস করলো সরদারকে।
-রতন বোধহয় ফিরেছে।
একটু বিরক্ত হলেও উদ্বিগ্নতার কোন লক্ষন ছিল না সরদারের মধ্যে।
প্রদিপকে নিয়েই ঘরে ঢুকলো ও।
এমন একটা পরিস্থিতিতে ভিতরে ঢুকতে ইতঃস্তত বোধ করছিল প্রদিপ।
-আপনি আসেন, কোন সমস্যা নেই, রতন ফিরলি এমন কান্ড ঘটেই। এখনই ঠিক হয়ে যাবে সব।
পুরনো ইটের গাথুনির উপর টিনের ছাউনি দেয়া দুটো ঘর নিয়ে বাড়ীটা ওদের। প্রথম কামরায় একটা খাট পাশে রং চটা তেল চিটচিটে গদি বসানো কাঠের একটা সোফা। ওটার উপরেই হেলান দিয়ে গা ছড়িয়ে বসে রতন।
মোটা শরীর। গায়ের রংটা কুচকুচে কালো। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল।
বাবার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালো। পরোক্ষনেই পিছনে প্রদিপকে দেখে সংদিগ্ধ হয়ে উঠে দাড়ালো রতন।
বেড়ার ওপাশের ঘর থেকে তখনও ওর বউয়ের কান্নার শব্দ ভেষে আসছে।
সরদার ঈশারা করে সোফায় বসতে বললো প্রদিপকে। রতন একটু সরে খাটের ধারে গিয়ে দাড়ালো।
মাথায় চুলগুলো এলোমেলো। চোখ দুটো লাল টকটকে। গায়ে একটা ময়লা গেঞ্জি আর পরনে ঢিলা করে পরা লুঙ্গি।
-বয় রতন, তিনি আয়ছেন আমাদের সাথে কথা বলে কিছু খবর সংগ্রহ করতি।
-আমার আবার কি খবর, বস্তির কোন ব্যপারের লগে আমি নেই। গোমরা মুখে উত্তর দিল রতন।
রতনের কথা বলার ধরণ দেখে বোঝা গেল মাতলামোর ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি তখনও।
কয়েক দিনের শেভ না করা দাড়িগুলো সাদা কালো হলেও বয়সটা প্রদিপের থেকে খুব একটা বেশী হবে না বলে বোধ হলো।
-তুমি বস শান্ত হয়ে। শারীরিক ভাবে দুর্বল মনে হচ্ছে তোমাকে।
রতন তেমনি সন্দিগ্ধ হয়ে তাকিয়ে।
প্রদিপ সরাসরি তাকিয়ে রতনের চোখে।
ধীরে ধীরে খাটের এক কোণায় বসলো রতন। চিন্তাক্লিষ্ঠ দেখাচ্ছে ওকে। ঘুমের ঘাটতি ওর চোখে মুখে প্রতিভাত।
সরদার বসলো সোফার অন্য পাশটাতে।
-চেচামিচি করছিল কে?
-আমার বাড়ী আমি চেচামিচি করবো না তো করবে কে?
তেমনি গোমরা মুখে উত্তর দিল রতন।
-বাড়ীটা নিজের বলেই চেচামিচি করতে হবে?
-ঠিক আছে অপরাধ হয়েছে ক্ষেমা চাচ্ছি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন থানায় যাতি পারবো না।
-হারামজাদা, চোরের মন সব সময় পুলিশ পুলিশ।
সরদার ছেলের ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলো।
– এনজিও থেকে এয়েচেন তিনি। বস্তির সবাই চেনে তিনাকে। তুই কোথায় থাকিস তার ঠিক নেই তায় তুই চিনবি কি করে। বস্তির সব বয়সী মানুষদের লিষ্টি করে আস্তে আস্তে সবাইকে কাজ দেবেন তিনার এনজিও।
সরদার আর প্রদিপ মিলে ব্যপারটা রতনকে বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
মাধুকরী এসে দাড়ালো কথার ফাকে।
সুঠাম দেহের অধিকারী ফর্সা সুশ্রী, বয়স বিশের কোটা ছাড়িয়েছে। পেটা শরীর, কম করে হলেও ষাড়ে পাচ ফুটের উপর ওর উচ্চতা। লাল একটা ব্লাউজ আর সবুজের উপর সাদা চেকের পুরনো একটা শাড়ী পরনে। ছেড়ে দেয়া অগোছালো চুলে একটা লাল ফিতা ঝুলে আছে। যৌবনটা উকি দিচ্ছে ওর সর্বাঙ্গে অগোছালো শাড়ী আর ব্লাউজের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে।
মুখ চোখ মুছে আসলেও চোয়াল দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু ঝরার দাগটা পরিষ্কার।
শরীর থেকে সস্তা একটা তেলের গন্ধ আসছে ভুর ভুর করে। বমি আসার মত। কিন্তু এই মুহুর্তে তেমন কিছুই বোধ হলো না প্রদিপের।
অপূর্ব লাগলো ওকে প্রদিপের। ও যেন ভরা বর্ষায় পূর্ণ পরিস্ফুট নাম না জানা বন্য এক ফুল।
চোখ যেন ফিরতে চায় না ওর উপর থেকে।
তবুও জোর করে চোখ ফিরিয়ে নিল প্রদিপ।
মাধুকরীর স্বামী হিসেবে রতনের উপর এমনিতেই একটু মায়া জন্মালো।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.