দেনাদার ও পাওনাদার

 

-শোন নরাধম, এই জমি খন্ড আমি তোকে হস্তান্তর করলাম। অতল সম্ভাবনাময় এ জমি, এর ফলন ক্ষমতা অপরিসীম। ফলনের জন্য প্রয়োজনীয় জল হাওয়া তাপ ইত্যাদি আমি সরবরাহ করব। তোর সব শারীরিক মানসিক প্রয়োজন মিটাতে আমি আরো অগনিত জীব ও জড় কিছুর সৃষ্টি করেছি। আমার সৃষ্টির মাঝেই আমি বাস করি, আর সৃষ্টির মধ্য দিয়েই আমার প্রকাশ ঘটে। অত সব নিয়ে তোর তেমন মাথা না ঘামালেও চলবে। তবে তোর প্রয়োজন মত ফসল ফলাতে হলে সময়ে সময়ে অতিরিক্ত কিছু জল খাবার জমি খণ্ডকে সরবরাহ করতে হবে, ব্যাস। আর আমার কথা সরণে রাখবি, কারণ প্রয়োজনে আমার কাছেই তো চাইতে হবে তোকে।
নরপতি নরাধমকে ডেকে কথাগুলো বলল।
-এটা মেয়াদি হস্তান্তর, তবে সেটা নিয়ে তোকে অত চিন্তা করতে হবে না। আমার সৃষ্টিতে যা কিছু শরীরী তা সব কিছুই মেয়াদি। যত দিন জমিটা তোর দখলে থাকবে বুঝবি ওটা ততোদিন পুরপুরি তোর, রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব থাকবে তোর উপর। মেয়াদ সম্পর্কে বেশী চিন্তা না করে যত দিন আমার এই অপূর্ব দান তোর কাছে থাকবে তার প্রতিটা দিন এটার যত্ন দিয়ে এর অপরিসীম ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করার চেষ্টা করবি।
একটু থামলেন নরপতি।
-তোর মত এমনি দান আমি অগনিত প্রাণকে করেছি।
নরপতির কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনে নরাধম হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতে লাগলো। নরপতির এই দানের জন্য নরাধমের হৃদয়ে গভীর কৃতজ্ঞতাবোধের জন্ম নিল।
নরপতির দানকে সঠিক ভাবে যত্ন নিয়ে তা থেকে নিজের প্রয়োজনীয় ফসল ফলিয়ে সেগুলো ঘরে তুলতে বদ্ধপরিকর হল মনে মনে। তার বিনিময়ে নরপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিষয়টিও সর্বোপরি গুরুত্বে রাখলো।

নরাধমের দিন শুরু হয় নরপতির দেয়া জমি খণ্ডের যত্ন আবদারের মধ্য দিয়ে। ওর সারা দিন কেটে যায় জমির যত্নের পিছনে। আর প্রতিদানও পায় ওর পরিশ্রমের। দিনে দিনে ও বুঝতে পারে নরপতির উক্তির সত্যতা -এর ফলণ ক্ষমতা অপরিসীম।
ভোরে ঠিক সময় মত সূর্য উদয় হয়, সময় হলেই বৃষ্টি পড়ে আকাশ থেকে, আর বাতাস সেতো সব সময় বইতে থাকে। নরপতি তাঁর অঙ্গীকার সঠিক ভাবে সঠিক সময়ে রক্ষা করে।
এসব চিন্তা করে নরাধমের চোখ দুটো কৃতজ্ঞতার জলে ভরে যায়। নরাধম নীরবে বসে দাঁড়িয়ে বা নতজানু হয়ে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই তাঁকে দেখার আর উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। তাঁর অন্য সব সৃষ্টির প্রতিও নিজের সাধ্য অনুযায়ী দরদ প্রকাশ করে স্রষ্টাকে খুশী করতে চায় নরাধম।
বিধাতার দান জমি খন্ডের অপার সম্ভাবনা দিনে দিনে নরাধমের কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। অবাক হয় নরাধম। এ সম্ভাবনার যেন কোন শেষ নেই।
ফসল উৎপাদনের পরিমান বেড়ে যাওয়াতে অঞ্চলের জমিদার তার নায়েবের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করে তার উপর খাজনা আরোপ করে। এতে অবশ্য নরাধমের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ ফসলের তুলনায় খাজনার অংক তেমন বেশী না। ফসল ওঠার পর পরই নরাধম সঠিক সময়ে খাজনা পরিশোধ করে দেয়। সে জন্য নরাধম জমিদারের চোখেও ভাল খাজনাদাতা হিসেবে পরিচিত এবং তার এ গুনের জন্য জমিদার তাকে পুরস্কৃতও করে থাকে। ভাল খাজনাদাতা হিসেবে জমিদারের বিভিন্ন পাক্ষিক আচার অনুষ্ঠান পালনের সময় নরাধম বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত হয়ে আপ্যায়িত হয়ে থাকে।
দিনে দিনে বিধাতা প্রদত্ত জমি খণ্ডের যত্নের দিকে বেশী বেশী মনোযোগী হয়ে ওঠে নরাধম। জমি খন্ড যত পুরনো হতে থাকে ততই সেটাকে বেশী বেশী যত্ন নিতে হয়। সব সময় সেটার খোঁজ খবর রাখতে ব্যস্ত থাকতে হয় আর তাই এখন ওর চেতন মনে আগের মত স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধটা জাগ্রত রাখতে পারে না। বিধাতার দানের কথা স্মরণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার বিষয়টা ওর অবচেতন মনে থাকলেও চেতন মনে সারাক্ষন বিধাতা প্রদত্ত জমি খন্ডের ভাল মন্দ আর সম্ভাবনার কথাই ঘুরতে থাকে।
সময় বয়ে চলে নিজ গতিতে। এরই ক্ষনে ক্ষনে বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিষয়টা নরাধমের উপলব্ধিতে আসে। নিজের কাছে অপরাধি মনে হয় নরাধমের। ভাবে এ ভাবে চলা কোনক্রমেই ঠিক না।
ভাবে কি করা যায়?
অপার সম্ভাবনাময় জমি খণ্ড থেকে বেশী বেশী ফসল পেয়ে নরাধম জমি সংক্রান্ত কাজকর্ম এবং জমি খন্ড নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ইত্যাদির চিন্তাই বিভোর থাকে। বলতে গেলে সংগত কারণে জমি খন্ড নিয়েই নরাধনের সব চিন্তা চেতনা গবেষণা ইত্যাদি ওকে সারাক্ষন ব্যস্ত রাখে।
তাই নরাধম যখন একাকী থাকে বা হাতে কাজ কম থাকে তখন বিধাতার প্রতি চেতন মনে কৃতজ্ঞতা না জানানোর কারণে একটা অপরাধ বোধ ঘুরপাক খায়।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে নরাধম প্রতিদিন কিছুটা সময় নির্দিষ্ট করে সেসময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে বলে পরিকল্পনা করে। আর সে মতই জমির যত্ন নেয়ার পাশাপাশি বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কাজটাও নিয়মিত চলতে থাকে।
কঠোর পরিশ্রমের পর উৎপাদিত ফসল হিসেব করে নায়েবের দেয়া রশিদ দেখে জমিদারের খাজনা পরিশোধ করার পর বিশাল পরিমান ফসল ঘরে তুলে মনে শান্তি লাগে নরাধমের। ঘরে তোলা ফসলের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যেমন শরীর মন ভাল থাকে তেমনি নিয়মিত বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কাজটা শেষ করার পরও মনে একটা অন্যরকম জোর অনুভব করে নরাধম।
মূলত তিন ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে নরাধমের জীবনটা আবর্তিত হয়।
প্রথমটা, জমির যত্ন নেয়া, এ কাজটি নরাধম তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান মেধা খরচ করে থাকে। কারণ এর উপরই ওর অস্তিত্ব নির্ভর করে। এ কর্মের ফলটা বস্তুগত তায় তা দেখা যায় পরিমাপ করা যায়। সর্বোপরি ফসলের চারা দেখে ফলনটা কেমন হবে সেটা অনেকটাই নির্ভুল ভাবে আগাম বলা যায়। এ কর্মের ফলটা ও হাতে নাতে এবং নিয়মিত পেয়ে থাকে।
দ্বিতীয় কাজটা হল জমিদারের খাজনা পরিশোধ করা। সেটাও নরাধম নিয়মিত ভাবে করে থাকে। তার জন্য ওর কোন আলাদা কিছু করতে হয় না। নায়েব নির্ভুল ভাবে হিসেব করে দেয় সময়মত। আর এ কাজের ফলটাও নরাধম নিয়মিত ভাবে জমিদারের কাছ থেকে বিভিন্ন আদর আপ্যায়নের মাধ্যমে পেয়ে থাকে।
তৃতীয় কাজটা, যা নরপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এই কাজটা প্রথম দুটো কাজ থেকে সর্ব বিবেচনায় একদম আলাদা। এ কাজটার ফল লাভ বস্তুগত জগতে ঘটে না।
এই কৃতজ্ঞতা জানানোর কাজটি করতে হয় একান্ত হৃদয়ের আকর্ষণে। আর এর ফল লাভ ঘটে অনুভবে, হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধরা ছোয়ার অনেক ঊর্ধ্বে।
মূলত জমি খন্ডকে ঘিরে নরাধমের কর্মতৎপরতা ওর মূল চালিকা হিসেবে কাজ করে। বস্তুগত জগত নিয়ে আষ্টে পিষ্টে নিমগ্ন নরাধম দিনে দিনে বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর কাজের ফল লাভের বিষয়টিও বস্তুগত জগতের সাথে মিলিয়ে ফেলে।
দিনে দিনে বিধাতাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কাজটিও জমিতে সময়মত চাষ দেয়া, সার প্রয়োগ করা বা পানি সেচ দেয়া এবং জমিদাদের খাজনা দেয়ার মত পার্থিবতার সাথে তুলনা করে ফল লাভটার হিসেব সহজ করে ফেলার একটা প্রবনতা ধীরে ধীরে নরাধমের ভিতর জন্ম নেয়।

নরাধমের চাল চলনের ভিতরও একটা পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
আজকাল নরাধম তার জ্ঞান আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের মৌসুমের প্রারম্ভে কচি কচি চারা দেখে আগাম ফল ভোগটা হিসেব করে নিশ্চিন্তে বুক উঁচিয়ে হাটাচলা করে। তার পাশের জমি খন্ডে খারাপ ফসল হলে নিজেরটা দেখিয়ে অন্যদেরকে মাঝে মাঝে লেকচারও দিয়ে থাকে নরাধম।
এছাড়া জমিদারের খাজনা গুনে গুনে মিটানোর বিনিময়ে জমিদারের কাছে অতিরিক্ত খাতির আর আপ্যায়ন লাভ করার বিষয়টি নরাধম অর্জিত অধিকার বিবেচনা করে তা গর্বভরে তার চালচলনে প্রদর্শন করে জমিদারের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে সামনের কাতারে বড় চেয়ারটাতে বসে। চেয়ারটা বড় না হলে বা তার বসার কাতার একটু এদিক ওদিক হলে, সর্বোপরি জমিদারের পাইক পেয়াদারা সঠিক ভাবে তাকে সন্মান প্রদর্শন না করলে নরাধম মেজাজ হারিয়ে ফেলে। ওকে পাওনা সন্মান না দেখানোর জন্য তাদেরকে তিরস্কার গালমন্দ করে জমিদারের কাছে নালিশ করারও ভয় দেখাই।
এটাকে দেনাদার-পাওনাদার মনোভাব বলা যায়। পাওনাদারের পাওনা শোধ করার পর দেনাদার নিজেকে পাওনাদারের সমকক্ষ ভাবতে থাকে।
অনেকটা তেমনি ভাবেই বিধাতার প্রতি সঠিক ভাবে এবং সঠিক সময়ে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের আচার অনুষ্ঠান পালনের বিনিময়ে তাঁর কাছ থেকে ফল লাভের ব্যাপারেও ধীরে ধীরে নরাধমের মধ্যে এক প্রকার মনোভাবের জন্ম নেয়। নরাধম তার এ মনোভাব ওর অঙ্গসৌষ্টবের প্রদর্শন আর নিজের বিভিন্ন আচার আচরণের মাধ্যমে জানান দিয়ে থাকে। এর ফল হিসেবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও সামনের কাতারে বড় আসনটা তার প্রাপ্য বলে দাবী করে নরাধম। আর সে সমাদর না পেলে নরাধম অধৈর্য হয়ে অন্যান্যদের বকাবকিও করে থাকে।
বোঝা যায়, নরাধম নিজের অজান্তেই অপার্থিব ফল লাভের বিষয়টিকে পার্থিব ফল লাভের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে নরপতিকে নরনেতা মহাজনের মত পাওনাদের কাতারে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। পার্থিব সবকিছু অংকের নিয়মে চলে কারন এখানে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অপার্থিব জগতের প্রতিনিয়ত বর্ধিষ্ণু বিশালতা যেখানে কোন কিছুর শেষ হয় না সেখানে পার্থিব অংক একেবারে অচল।
ভয় হয় পাছে বিধাতাকে নিয়মানুযায়ী কৃতজ্ঞতা জানানোর ফল লাভের ব্যাপারে অতি নিশ্চিত হওয়ার ফলে, বিধাতার সাথে নরাধমের মনোভাব পাওনাদার- দেনাদারের সম্পর্কের মত হয়ে না যায়।

নরপতি সেত বিধাতা মহাস্রষ্টা
ভূত ভবিষ্যৎ কাল মহাকালের সর্বদ্রষ্টা।
কার সেবা নেবে, কাকে ফিরিয়ে দেবে
কেউ জানে না তা আগাম, তিনি ছাড়া অন্য কোন নাম।

পৃথিবী সেতো ক্ষুদ্র বিন্দু খন্ড, অনন্ত অসীম বিশ্ব ব্রমান্ড।
এ পৃথিবীর যা কিছু শরীর-জীব আর জড়
হোক না তা যত শক্তি যত বড়
বিন্দু সমও নয়, বিশাল পৃথিবীর তুলনায়।

বিশ্ব ব্রমান্ড, কত বিশাল কত প্রকান্ড, কেউ তা না জানে
পরিমাপ অসম্ভব মনুষ্য জ্ঞানে, যা হচ্ছে প্রসারিত প্রতিক্ষনে।

সহ-স্রষ্টা বেশে এ পৃথিবীতে এসে বাস করিছে বিধাতা স্বয়ং
সৃষ্টির সাজে সকলের মাঝে প্রকাশিছে নিজেকে সারাবেলা সারাক্ষণ।

প্রতিটি সৃষ্টি এ ধরাতে, স্রষ্টার বাস তাতে বস্তু আকারে।
সবই মহাশক্তির আধার, বাহিরে পৃথক অভিন্ন ভিতরে।

নরনেতা মহাজন সেও তো পৃথিবীর নরাধম একজন
একটু বেশী হিসেবী মন তার, তাইতো সে জমিদার।
দলে দলে যত বিভেদ, যত ভেদাভেদ, যত বিভাজন
ততো নরনেতা ততো মহাজন
সবে মনে করে, নরপতির পরে তাদের আসন।

নরাধম সেত অধমের অধম সময়ের কাছে বড় অসহায়
প্রতিক্ষন হয় শুধু ক্ষয় তারপর একদিন নিঃশেষ হয়ে যায়।

আমি প্রজা তুমি প্রভু, আকার নিরাকার কভু কি মিলন হয়?
আকার না ছেড়ে, নিরাকারের নীড়ে ফেরা সম্ভব নয়।

Category: Meaning of Life, Posts

Comment List

Your email address will not be published.