অসহায় মানুষ- ১

 

প্রদিপ নেওয়াজ কলেজের সেরা ছাত্র, জীবনে সেকেন্ড হয়নি কখনো। সুঠাম দেহের অধিকারী প্রদিপ। পাচ ফুট দশ ইঞ্চির মত লম্বা, সুচালো নাক, চোখ দুটো বড় বড়, ফর্সা গায়ের রঙে ওকে এক কথায় সুশ্রী বলা যায়। ছোটকাল থেকেই ভালো স্পোর্টসম্যান। কলেজের ফুটবল দলের একজন সেরা খেলোয়াড়। ফরোয়ার্ড লাইনের প্লেয়ার ও। গোল ঠেকানো নয় বরং গোল করাতে বেশী আনন্দ পায় প্রদিপ। টিমের পক্ষে গোলটা করা মোটামুটি ওরই একচ্ছত্র অধিকার।
টিম জেতার পর অন্যান্যদের কাঁধে চড়ে হাজার দর্শকের করতালির মধ্যে মাঠ প্রদক্ষিন করার মজাটাই আলাদা। প্রদিপ দারূন ভাবে পছন্দ করে ব্যাপারটা। অর্জনের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে বিশ্বাসী ও। আর অর্জনটা যখন হাজার মানুষের সামনে করতালির মধ্যে স্বীকৃত হয় তখন সেটা অন্য মাত্রা লাভ করে।
সেবার ইন্টার কলেজ চ্যামপিয়ানশীপ লীগ খেলায় অংশ নিতে নিতে মাঝপথেই হটাৎ করেই ফুটবল খেলা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল প্রদিপ। এটা ওর এক ধরণের খামখেয়ালীপনা বললো অনেকে। এধরণের খামখেয়ালীপনায় পারদর্শী ও। কখন যে কোনটা ওর মাথায় চেপে বসে তা বলা মুশকিল।
ওর বন্ধুরা এমনকি অন্যান্য সব শিক্ষকেরা মিলে শত অনুরোধ করেও ওকে টিমে ফেরাতে অসমর্থ হলো।
লীগ পদ্ধতির খেলা। এ পর্যন্ত প্রতিটি খেলায় টিম জিতেছে। নক আউট পর্ব শুরূ হবে সেমি ফাইনাল থেকে। সেমি ফাইনালে টিম জিতবে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই গেমস টিচার আলমগীর হোসেনের, তায় এ পর্বের জন্য তেমন চিন্তিত নন তিনি। তার চিন্তা ফাইনালে জয়লাভ করা। কারণ অন্য গ্রুপ থেকে নিঃসন্দেহে উঠে আসবে চির প্রতিদ্বন্দী সিটি কলেজ টিম।
সিটি কলেজ টিম ফুটবলের ব্যপারে ওদের চিরপ্রতিদ্বন্দী। সিটি কলেজের সাথে টিম খেললে শিক্ষক গার্জিয়ান ছাত্র সবাই খুব আবেগপ্রবন হয়ে ওঠে। লীগ হারা জেতার থেকে মুখ্য হয়ে ওঠে সিটি কলেজের সাথে জয়লাভ করা।
এ বছর গোড়া থেকেই সিটি কলেজ দলের প্রতিটি খেলা গেমস টিচার গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। গত বারের তুলনায় এবার ওদের টিম অধিক শক্তিশালী, বিশেষ করে ওদের ষ্কোরারগুলো খুবই ভালো। সিটি কলেজকে হারানোর থেকে ওরা যেন মূল খেলায় কোনক্রমে গোল করতে না পারে সেটায় তার টিমের এবার প্রধান লক্ষ্য বলে নির্ধারণ করেছেন গেমস টিচার। ড্র করতে পারলে পরে টাই ব্রেকারে টিমের জেতার একটা সম্ভাবনা আছে। তাতে কলেজ চ্যাম্পিয়ান হবে। তায়তো টিমের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্লেয়ার হিসাবে প্রদিপকে ডিফেন্সে খেলানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।
-পরিবর্তনটা একটু আগেভাগে করলে প্রদিপ তার নতুন জাইগায় খেলার জন্য প্রাকটিসটা করতে পারবে। ভাবলেন গেমস টিচার আলমগীর হোসেন।
প্রিন্সিপালের সাথে পরামর্শ করে সেমি ফাইনাল খেলার আগে কৌশল বদলানোর জন্য টিমে কিছু পরিবর্তন আনলেন গেমস টিচার। তাতে করে প্রদিপকে ফরোয়ার্ড থেকে সরিয়ে ডিফেন্সে আনা হলো।
সেমি ফাইনালের আগের দিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রদিপ জানালো ও আর ফুটবল খেলবে না।
শত অনুরোধ করেও কেউ ওকে রাজি করাতে পারলো না।
গেমস টিচার আলমগীর স্বয়ং আসলেন ওর কাছে।
তিনি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তাকে পরিবর্তন করা হচ্ছে ওর উপর সকলের ভরসা আছে বলে। তিনি পরিবর্তনটা করেছেন ফাইনালের কথা মাথায় রেখে। কারণ ফাইনালে ওদের প্রতিপক্ষ সিটি কলেজ।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
অগত্য প্রদিপকে ছাড়াই টিমকে সেমি ফাইনাল খেলতে হলো। কোন রকমে টিম ফাইনালে উঠলেও প্রতি মুহুর্তে প্রদিপের অভাব বোধ করলো টিমের প্রতিটি খেলোয়াড়।
অবশেষে প্রিন্সিপাল নিজে আসলেন প্রদিপের কাছে। কলেজের এতবড় একটা সম্মান প্রদিপের উপর নির্ভর করছে বলে জানিয়ে তিনি ওকে খেলার জন্য অনুরোধ করলেন।
মৃদু হেসে খেলার জন্য রাজি হলো প্রদিপ।
ফাইনাল খেলার সময় প্রকৃতই দেখা গেল সিটি কলেজের আক্রমনভাগের প্লেয়াররা সত্যিই খুব চৌকস। গেমস টিচারের রিডিংটা সঠিক। অন্যদিকে মোটামুটি প্রদিপের দক্ষতার জন্য প্রতিপক্ষ ওদের সব ক’টি স্কোর করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো।
খেলাটা নিশ্চিত ভাবে ড্রর দিকেই এগোচ্ছিল।
খেলার ঠিক দুমিনিট আগে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না প্রদিপ। নিজেদের মধ্যে তাৎক্ষনিক বোঝাপড়া করে ডিফেন্স লাইন ছেড়ে ফরোয়ার্ডে অবস্থান নিল প্রদিপ। গেমছ টিচার হাহুতাস করার আগেই সবাইকে তাক লাগিয়ে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রদিপ একমাত্র গোলটি করলো দলের পক্ষে।
খেলা শেষের বাশি বেজে উঠলো।
প্রদিপের জয়ধ্বনিতে মেতে উঠলো সবাই। হাজারো দর্শকের করতালি আর আনন্দ চিৎকারের মধ্যে সহপাঠিদের ঘাড়ে চড়ে জয়ধ্বনি দিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করলো প্রদিপ।
বিজয় উল্লাসের সব কার্য্যক্রম প্রদিপকে ঘিরেই আবর্তিত হতে লাগলো।

দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে প্রদিপ সবার বড়। বাবা নাসিম নেওয়াজ শহরের একজন নামকরা ব্যক্তিত্ব। কয়েকটা ইন্ডাস্ট্রির মালিক, তাছাড়া দু’ দুবার সরকারের মন্ত্রি ছিলেন। বর্তমানে সক্রিয় রাজনীতি না করলেও পুরনো ও সৎ রাজনীতিবীদ হিসাবে সবাই তাকে সমাদর করে।
ওর অন্য দুই ভাইবোনদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা প্রদিপ। শারিরীক মানসিক সব দিক দিয়েই।
বিপদে বা প্রয়োজনে অন্যকে সাহায্য করার একটা প্রবনতা আছে প্রদিপের মধ্যে ছোটকাল থেকেই। বিশেষ করে যারা দরীদ্র আথবা জন্ম থেকেই বঞ্চিত তাদের প্রতি ওর একটা আলাদা রকমের দরদ আছে।
অন্য ভাইটা প্রদিপের তিন বছরের ছোট নাম পলাশ। বাবার মত শ্যমলা আর একটু ভারী শরীরের। পলাশের দু বছরের ছোট উর্মিলা। বোনটার গায়ের রং মায়ের মত ফর্সা তবে নাকে চোখে প্রদিপের মত নয়।
প্রদিপের মত মেধাবীও নয় ওরা কেউই। দুজনই কিছুটা অলস কেতাদুরস্ত এবং বিলাসী।
বাবা মায়ের খুব প্রিয় সন্তান প্রদিপ। এ সব কিছুর জন্য বাবা মায়ের কাছে প্রদিপের একটা বিশেষ স্থান আছে।
পরামর্শ দানের ব্যাপারেও বিশেষ পারদর্শী প্রদিপ। বাবা অনেক বিষয়েই বড় ছেলের পরামর্শ গ্রহন করে থাকেন। প্রদিপ ছোট ভাই বোনদেরকে সব সময়ে পড়াশোনা সহ নানা ব্যপারে পরামর্শ দান করে।
প্রায় দুশো বছরের পুরনো বংশ ওদের। পুরনো জমিদার বাড়ীর আদলে তৈরী ওদের বাড়ীটা। শহরের উপকণ্ঠে অনেক জায়গা জুড়ে পাচিল ঘেরা বাড়ী। ওরা বাদেও বাড়ীতে আরো প্রায় দশ বারো জন বিভিন্ন কাজের মানুষ বসবাস করে। তাদের সবার সাথেই বিশেষ সখ্যতা প্রদিপের।
অবসর সময়ে বা পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে প্রদিপ যায় ওদের ঘরে, বসে নানান কথা বলে। এদের সবার পরিবার পরিজন সম্পর্কেও যাবতীয় খোঁজ খবর রাখে প্রদিপ।
এরা সবাই প্রদিপকে খুব পছন্দ করে। সবাই ছোট খাট ব্যাপারে প্রদিপের কাছ থেকে পরামর্শও গ্রহন করে। এদের সবাই বিপদের সময় প্রদিপের কাছ থেকে কোন না কোন ভাবে কম বেশী সাহায্য সহযোগিতা বা আশ্রয় পেয়েছে। তায় সবাই ওর কাছে বিভিন্ন ভাবে ঋণি।
ওরা নিজ থেকে সাহায্য না চায়লেও প্রদিপ বিভিন্ন কথায় কথায় ওদের সমস্যার কথা জানতে চেষ্টা করে আর তা জানার পর সাধ্যমত সাহায্য করে।
ছোট বেলা থেকেই এটা ওর একটা সখ বা অভ্যাস।
প্রদিপের বাবা নাসিম নেওয়াজ ছেলের এ বিশেষ গুনের কথা জানেন এবং ওর এ গুনের জন্য সবার কাছে ছেলের প্রশংসাও করেন। কাজের লোকজনের ব্যাপারে প্রদিপের যে কোন সুপারিশ ওর বাবা মেনে নেন সব সময়।
কাজল মিঞা ওদের পুরনো ড্রাইভার, বয়স চল্লিশের উর্দ্ধে। খুব বিশ্বস্থ নেওয়াজ পরিবারের সবার কাছে। ছোট কালে প্রদিপকে কোলে কাধে নিয়েছে।
নাসিম নেওয়াজ বাদে পরিবারের অন্য সকলে কাজলের চালানো গাড়ীটা ব্যবহার করে। সেই ছোট কাল থেকেই প্রদিপকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করে কাজল।
পরিবার নিয়ে কাজল মিঞা ওদের বাড়ীর বাউন্ডারীর ভিতর একটা বাসায় বসবাস করে। খুব ভোরে বেলা সবাই উঠার আগেই উঠতে হয় ওকে। কাজল সকাল সাতটা বাজার আগেই গাড়ীটা ধুয়ে মুছে রেডি করে।
অন্য গাড়ীটা ব্যবহার করেন নাসিম নেওয়াজ। ওই গাড়ীটা কারখানাতে থাকে আর ও গাড়ীর ড্রাইভার তার পরিবার নিয়ে কারখানার কোয়াটারে বসবাস করে।
প্রতি মাস শেষে নিয়মিত ভাবে বেতন পায় কাজল মিঞা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাস শেষে প্রদিপ ওর নিজের সাশ্রয় করা টাকা থেকে দু পাচশো টাকা ওকে দেয়। কাজল মিঞা নিতে চায় না, তবুও জোর করে দেয়। দিনে দিনে ওটা প্রায় রূটিন হয়ে দাড়িয়েছে।
এ ধরণের সাহায্য প্রদিপ ওদের বাড়ীর অন্যান্য কর্মচারীদেরকেও করে থাকে।
-প্রদিপের আসল জন্ম বোধহয় ওরকম কোন ঘরে।
অনেক সময় বিরক্ত হয়ে ওর ভাইবোন বা বন্ধুরা এ ধরনের কথা বলে হালকা রশিকতা করে। এধরনের রশিকতা প্রদিপকে কোন ভাবেই স্পর্শ করে না। বরং এধরণের মন্তব্যকে ও সম্মান সুচক বলে বিবেচনা করে।
প্রদিপ ওর সাথে পড়া বন্ধু বান্ধবদেরকেও এভাবে না চায়তে অনেক কিছু উপহার হিসেবে প্রদান করে থাকে।
বিনিময়ে ও চায়না কিছুই কারো কাছ থেকে। কোন কিছু আশাও করে বলেও মনে হয় না। তায় সবাই এটাকে ইতিবাচকই বিবেচনা করে। কেউ কেউ আবার কটাক্ষ করে এটা বড় লোকের ছেলের একটা খেয়াল বলেও মন্তব্য করে। যাহোক, অমন মন্তব্য ওর কানে আসলেও কোন রকম মনোহত হয় না প্রদিপ।
মাস্টার্স শেষ করে প্রদিপ এম ফিল করতে শুরূ করলো। দেশের শত কোটি দুখী বঞ্চিত মানুষদের পুনর্বাসনের বিষয়ে গবেষণা করবে বলে ঠিক করল ও।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.