মায়ের ত্যাগ

 

 

আমার মায়ের শুধু একটা চোখ ছিল। তার এই চেহারা আমার কাছে তাকে খুব বিব্রতকর লাগতো। মায়ের এমন বিদঘুটে চেহারার জন্য প্রকৃত পক্ষে আমি তাকে ঘৃণা করতাম। খোলা বাজারে আমার মা একটি ছোট দোকান চালাতো। সে বিভিন্ন জলা বা জংগল থেকে শাক সজবি ইত্যাদি তুচ্ছ দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে আমাদের অর্থের প্রয়োজন মেটাতো। এ সব কিছুই আমার জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল।

আলোচ্য ঘটনাটি ঘটে আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি।

মনে আছে ওই দিনটিতে আমার খোলা মাঠে প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল এবং আমার মা আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তাকে দেখে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করলাম –জেনেশুনে মা কীভাবে আমার সাথে এটি করতে পারে? তার দিকে আমি ঘৃণা ভরে তাকিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। পরের দিন স্কুলে আমার সব বন্ধুরা … “তোমার মায়ের একটাই চোখ আছে!” বলে আমাকে ক্ষেপাতে লাগলো।

আমার মনে হতে লাগলো যে আমার মা এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় না কেন? তায় মাকে  বললাম, “মা, তোমার অন্য চোখটি কেন নেই? তোমার এই কুৎসিত চেহারা সবার সামনে আমাকে হাসির পাত্র বানিয়ে দেয়। তুমি মরে যাও না কেন?”

আমার কথায় মা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আমি কিছুটা খারাপ অনুভব করলাম। তবে একই সাথে, এটি ভেবে ভাল লাগলো যে আমি এতদিন ধরে যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম তা আজ বলতে পেরেছি। ভাল লাগার কারন অন্য কারণটি ছিল যে মা আমাকে শাস্তি দেননি। তবে আমার কিছুতেই মনে হয়নি যে আমি তাকে খুব খারাপভাবে আঘাত দিয়েছি।

ওই রাতে পিপাসা লাগায় আমি ঘুম থেকে উঠি জল খেতে রান্নাঘরে গেলাম। বুঝলাম সেখানে বসে মা নীরবে কাঁদছে, আমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে বলে সে কোন রকম আওয়াজ করছে না। আমি নিঃশব্দে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখে আমার শোয়ার ঘরে চলে গেলাম।

মাকে কটু কথা বলে আঘাত দেয়ার জন্য আমার মনের মধ্যে কিছুটা অনুশোচনা হলেও আমি মাকে ঘৃণা করতাম এই ভেবে যে তার একটা চোখ দিয়ে কাঁদছিল। আমি নিজেকে বুঝালাম যে আমি পরিশ্রম করে বড় হয়ে সফল হব, কারণ আমি আমার একচোখা মা এবং আমাদের দারিদ্র্যকে ঘৃণা করি।

আমার মনে এক ধরনের জিদ তৈরি হল। আমি খুব কষ্ট স্বীকার করে পড়াশোনা করে মাকে ছেড়ে  সিউলে আসলাম এবং আমার নিজ অধ্যবসায়ের জোরে সিওল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তারপরে আমি বিয়ে করলাম এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার নিজের একটি বাড়ি কিনলাম।  সময়ের ব্যবধানে আমাদের বাচ্চাও হল এবং এখন আমি একজন সফল মানুষ হিসাবে সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করলাম। আমি আমার বর্তমান জীবনকে খুব পছন্দ করতাম কারণ এখানে কোন কিছুই আমার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিত না।

আমার এই প্রাচুর্যে ভরা সুখের জীবন ক্রমশই সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠছিল। কিন্তু একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে একদিন কেউ একজন আমাকে দেখতে আসলো। বিরক্তি প্রকাশ করলাম –কী? এটা কে?! দেখলাম আমার মা …  এখনও সে তার ওই এক চোখ নিয়ে আছে। মনে হল পুরো আকাশটা আমার মাথার উপর ভেঙে পড়লো। আমার একচোখা মাকে দেখে আমার ছোট মেয়েটি ভইয় পেয়ে পালিয়ে গেল।

-তুমি কে? আমি তোমাকে চিনি না! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

-তোমার সাহস কি করে হল আমার বাড়ীতে আসার? দেখলে না, তোমাকে দেখে আমার ছোট্ট মেয়েটি ভয়ে পালিয়ে গেল। তুমি এখনি বেরিয়ে যাও। আমি চিৎকার করে উঠলাম।

-ওহ, আমি দুঃখিত বাবা, আমি হয়ত ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি। কথাটি বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম… যে মা আমাকে চিনতে পারেনি। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমি নিজেকে এটা বুঝিয়ে শান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করলাম যে, আমি সারা জীবনে এই ঘটনা সম্পর্কে চিন্তা করব না।

এর পর একদিন আমার বিদ্যালয়ের পুনর্মিলন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত একটি  চিঠি আমার বাড়িতে  এল। আমি আমার স্ত্রীকে মিথ্যা বললাম যে আমি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান শেষ হলে নিচক কৌতূহল বসত আমি পুরানো জায়গাটাতে গেলাম যেটা এক সময় বাড়ি বলে মনে করলাম।

দেখলাম আমার মায়ের দেহটা ঠান্ডা মাটির মেঝেতে পড়ে আছে। তা দেখে আমার চোখে একটুও জল আসলো না।

মায়ের হাতে একটা কাগজের টুকরো ছিল…। এটা আমার কাছে লেখা একটি চিঠি

সে লিখেছিল:

-বাবা, আমার মনে হয় এই শরীরে আমি অনেক দিন বেচে আছি। … তোমাকে দেখতে সিউলে যাওয়ার মত আমার আর সামর্থ্য নেই… তবে তুমি এখানে এসে একবার আমার সাথে দেখা করার অনুরোধ রক্ষা করতে কি তোমার খুব কষ্ট হবে সোনা। তোমাকে যে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হয়।

যখন জানলাম যে তুমি পুনর্মিলনের জন্য আসছো শুনে আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। তবে আমি স্কুলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি…। শুধু তোমার কথা ভেবে … আমি খুব দুঃখিত বাবা যে আমার  কেবল একটি চোখ যা সবার সামনে তোমাকে খুব বিব্রত করে।

-তুই তখন খুব ছোট, একটি দুর্ঘটনায় তোর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ছেলে একটি চোখ নিয়ে পৃথিবীতে বড় হবে একজন মা হিসাবে সেটা কল্পনা করে আমি চমকে উঠেছিলাম … আর তাই আমি তোকে আমার একটা চোখ উপহার দিয়েছিলাম …

আমি সব সময় গর্ব বোধ করতাম – আমার হয়ে আমার চোখ দিয়ে আমার ছেলে সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখবে।

তোমার কোন ব্যাবহারের জন্য আমি কখনই তোমার প্রতি বিরক্ত হোইনি বাবা। যে কয়েকবার তুমি আমার উপর রাগ করেছ, আমি নিজেকে বুঝিয়েছি –তুমি ওটা করেছ কারণ তুমি আমাকে ভালবাস।

-সোনা তুই ছোট কালে যখন আমার চার পাশে ঘুরঘুর করে আমাকে বিরক্ত করতিস সেই সময়গুলি কত ভাল ছিল। আমি তোকে খুব ভাল বাসি বাবা, তুই ছাড়া সব শূন্য শূন্য লাগে, তুই আমার জন্য পৃথিবী।

 

পৃথিবীটা থমকে দাঁড়ালো। আমি যে মানুষটিকে ঘৃণা করি সে কেবলমাত্র আমার জন্য বেঁচে ছিল। আমি বুক ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, মায়ের কথা মনে করে অনেক চেষ্টা করেও কাঁদতে পারলাম না। আমার হীন  কাজের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার কোনও উপায় আছে কিনা আমার সত্যিই জানা নেই … 

 

শিক্ষণীয়: প্রতিবন্ধীদের কখনও ঘৃণা বা অবজ্জা করা ঠিক না। পিতামাতাকে কখনও অসম্মান করা এবং তাঁদের ত্যাগ স্বীকারকে কখনো কাটো করে দেখার কোন অবকাস নেই। তারা আমাদের জন্ম দাতা, তাঁরা সব সময় তাঁদের যা আছে তার থেকে সবথেকে ভালটুকু আমাদেরকে দিয়ে তৃপ্তি পায়। তাঁরা চায় যে তাঁদের অবস্থানের তুলনায় সন্তানরা আরো উপরে উঠে যাক। বাবা মা তাঁদের দুঃস্বপ্নেও সন্তানের অকল্যাণ কামনা করে না। তাঁরা সর্বদা সন্তানদের সঠিক পথ প্রদর্শন করার চেষ্টা করে। বাবা মা সন্তানের জন্য সব কিছু ত্যাগ করে; সন্তানের সব ভুলকে ক্ষমা করে দেয়। মাতা পিতার ঋণ পরিশোধ করার কোনও উপায় নেই, আমরা যা করতে পারি তা হল তাদের যা প্রয়োজন তা দেওয়ার চেষ্টা করা এবং সেটি করার এখনি সঠিক সময় – তাঁদেরকে ভালবাসতে হবে আর শ্রদ্ধা করতে হবে।

Source: Google

Category: Bangla, Moral Stories

Comment List

Your email address will not be published.