দাদুর খাবার টেবিল

 

(সংকলিত)

 

 

 

বৃদ্ধ বয়েসে এক দুর্বল বাক্তি তার ছেলে, ছেলের বউ আর চার বছরের নাতির সাথে বসবাস করতে তাদের বাড়ীতে যান। বৃদ্ধজনিত কারনে লোকটির হাত সব সময় কাঁপতো, তিনি সব কিছুই ঝাপসা দেখতেন এবং কিছুটা এলোমেলো ভাবে হাঁটতেন।

প্রতিদিন পরিবারের সবাই একসাথে টেবিলে খেতে বসতো। তবে বৃদ্ধ দাদুর সর্বক্ষণ কাঁপতে থাকা হাত নিয়ে আর ঝাপসা চোখে সব কিছু আপছা দেখে সবার সাথে বসে নিজে খাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ছিল।   তিনি কোনোমতে কষ্টে শিষ্টে কোন কিছু চামচে উঠালে সেগুলি তার হাত কেপে  মেঝেতে পড়ে যেত। তিনি কোনোরকমে দুধের গ্লাসটি ধরতে পারলেও কাপা হাতে গ্লাসের দুধ ছিটকে টেবিলের চাদরের উপর পড়ে তা নষ্ট করত।  

এসবের জন্য ছেলে এবং তার স্ত্রী সব সময়ই বিরক্ত হতো।

-এভাবে চলে না, বৃদ্ধ বাবার জন্য আমাদের অবশ্যই কিছু করা উচিত। ছেলেটি মন্তব্য করলো। -লাগাতার খাওয়ার সময় খাবার দাবার ছড়ানো, দুধ ফেলে টেবিলের চাদর আর মেঝে নোংরা আর সহ্য করা সম্ভব না। এ বিষয়ে একটা কিছু করা দরকার।

তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করে খাবার ঘরের এক কোণে বৃদ্ধ বাবার জন্য ছোট একটা টেবিল সেট করলো। তাতে করে পরিবারের সবাই যখন রাতের খাবার একত্রে উপভোগ করতো বৃদ্ধ দাদু তখন ঘরের কোণে একাকী খাবার খেত। দাদু যেহেতু তার হাত কাপার জন্য চিনা মাটির  থালা বাটি মেঝেতে ফেলে ভেঙে ফেলত তাই তাঁর জন্য কাঠের থালা বাটির বাবস্থা করা হল।

খাবার টেবিলে বসে পরিবারের সবাই যখন একাকী বসে থাকা দাদুর দিকে তাকাতো তখন তারা দাদুর ঝাপসা চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে  দেখত। তথাপিও একাকী বসে খাবার খাওয়ার সময় যখনই তার কাঁপতে থাকা হাত থেকে চামচ মেঝেতে পড়ে যেত বা খাবার মুখে তোলার সময় তা ছিটকে মেঝেতে পড়তো তখন ছেলে ও তার স্ত্রী বৃদ্ধ দাদুকে বকাঝকা করত। চার বছর বয়সী নাতী সবকিছু নীরবে অবলোকন করত।

একদিন সন্ধ্যায় খাবারের কিছু পূর্বে বাবা খেয়াল করলেন যে তার চার বছরের ছেলে মেঝেতে কাঠের কিছু টুকরো নিয়ে খেলছে আর কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে। বাবা ছেলেকে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন –তুমি  কী বানাচ্ছো সোনা?

-আমি তোমাদের মত যখন বড় হয়ে যাব তখন বৃদ্ধ অবস্থাই তোমার আর  মায়ের খাওয়ার জন্য কাঠের থালা বাতি বানাচ্ছি। চার বছরের ছেলেটি  মিষ্টিভাবেই জবাব দিল এবং সে হাসি বজায় রেখেই আবার কাজে মন দিল।

চার বছরের নিষ্পাপ সন্তানের সরল কথাগুলি তার বাবা-মাকে এতটাই তীক্ষ্ণ ভাবে আঘাত করল যে তারা নির্বাক হয়ে গেল। তাদের দু চোয়াল বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তারা বাকরুদ্ধ হয়ে রইল এবং এর পর তাদের করনীয় সম্পর্কে তারা ওয়াকেবহাল হল।  

সেই সন্ধ্যায় ছেলে বৃদ্ধ বাবাকে সযত্নে তার হাতটা আলতো ভাবে ধরে   তাকে পরিবারের খাবার টেবিলে নিয়ে গেল। সেদিনের পর বাকি জীবন ছেলে ও ছেলের স্ত্রী বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে একসাথে এক টেবিলে বসেই খাবার খেল এবং বৃদ্ধ বাবার হাত কাপা বা চোখে ঝাপসা দেখার কারণে কাঁটাচামচ মেঝেই ফেলে দেওয়া, গ্লাস থেকে দুধ ছিটকে মেঝেতে পড়া বা টেবিল ক্লোথে পড়ে তা নষ্ট হাওয়ার ব্যাপারগুলো বৃদ্ধ বয়সী মানুষের স্বাভাবিক কর্ম বলে গণ্য করতে লাগলো।

শিক্ষণীয়: শিশুরা খুব আন্তরিকভাবে উপলব্ধিযোগ্য। তারা সব সময় নিরপেক্ষ ভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ও শ্রবন করে এবং তার  উপর ভিত্তি করে তাদের নির্মল মনের উপর ছাপ পড়ে। শিশুরা যদি দেখে যে বড়রা ধৈর্য ধরে পরিবারের সব সদস্যদের জন্য একটি সুখী ও সৌহার্দমুলক পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করেছে তবে তারা সারা জীবন সেই মনোভাব অনুকরণ করবে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পিতামাতারা বোঝেন যে তারা  শিশুর ভবিষ্যত গড়তে প্রতিদিন তাদের কার্যক্রমের দ্বারা বিল্ডিং ব্লক স্থাপন করছেন। আসুন আমরা আমাদের শিশুদের জন্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিল্ডার এবং রোল মডেল হই। কারণ শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। জীবনের সার্থকতা হচ্ছে মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করে একটি ইতিবাচক পার্থক্য তৈরি করা। আজ এবং প্রতিদিন নিজের যত্ন নিন এবং আপনি যাদের  ভালবাসেন তাদেরও যত্ন নিন।   

Category: Bangla, Moral Stories

Comment List

Your email address will not be published.