বিরবলের স্বর্গ ভ্রমণ

(সংকলিত)

 

 

সম্রাটের আকবরের দরবারে বীরবল সবার থেকে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ বাক্তি  ছিল সেজন্যই দরবারের অন্যান্য সদস্যরা তাঁর প্রতি ঈর্ষা  পোষণ করতো এবং  সবসময়ই তারা তাকে  কোন না  কোনও উপায় খুঁজে বের  করে হেয় করার চেষ্টা করতো।   

একদিন আদালতের নরসুন্দর বা নাপিত, যে বীরবলের প্রতি অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত ছিল, সে বিরবলকে হেয় করার একটি পরিকল্পনা করলো। নরসুন্দর রাজার দাড়ি ছাঁটাই করার সময় ফন্দি করে বললো  -স্যার, গত রাতে আমি  আপনার বাবাকে স্বপ্ন দেখেছি। তার বাবার ব্যাপারে বলাতে রাজা আগ্রহী  হয়ে  উঠলেন এবং নরসুন্দরকে জিজ্ঞাসা করলেন -বাবা তোমাকে  কী  বললো? 

-স্যার, তিনি আমাকে বললেন যে জান্নাতে সবকিছু ভাল তবে তিনি নিরান্দময় জীবন কাটাচ্ছেন আর তায় তিনি তাকে আনন্দ দিতে পারে এমন একজন ভাল রসিক মানুষের অনুপস্থিতি দারুনভাবে অনুভব  করছেন।

বিষয়টি রাজাকে ভীষণ চিন্তাগ্রস্থ করে তুললো। রাজা অনেক চিন্তাভাবনা করলেন এবং এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য বীরবলকে ছাড়া তিনি অন্য  কারো কথা তার চিন্তায় আসলো না।

-মৃত্যু  ছাড়া স্বর্গে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু বিরবলের মত একজন এক ভালো মানুষকে এ ভাবে হারানোর কথা ভেবে রাজার মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।  কিন্তু বাবার কথা ভেবে তিনি বীরবলকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য মনঃস্থির করলেন।  

রাজা বীরবলকে ডেকে বললেন- আমি মনে করি বীরবল তুমি আমাকে খুব ভালোবাস এবং তুমি আমার জন্য যে কোনও কিছু ত্যাগ করতে পারো। বীরবল রাজার এধরনের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই অনুমান করতে পারলো না।

-আপনি যথার্থই জানেন মহাত্বন যে আমি আপনার কল্যাণে নিয়োজিত। বীরবল উত্তর দিল।

-তাহলে বীরবল, দয়া করে আমার প্রিয় বাবাকে সঙ্গ দিতে তুমি স্বর্গে গমন কর। রাজার প্রস্তাবে বীরবল পরিস্কার বুঝতে পারলো যে তাকে হত্যা করার জন্য এটি কার দুষ্ট পরিকল্পনা। তিনি সম্রাটকে বিনয়ের সাথে বললেন –অবশ্যই আমি এটি করব, তবে স্বর্গে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আর তার জন্য আমার  সপ্তাহ খানেক  সময়ের প্রয়োজন। 

রাজা বললেন -অবশ্যই, তুমি আমাকে এত বড় অনুগ্রহ দেখাচ্ছ, আমি তোমাকে এক সপ্তাহের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার অনুমতি দেব।

বীরবল ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবল -কেউ খুব নিখুঁত পরিকল্পনা  করেছে এবং এই পরিকল্পনা থেকে সে পালাতে পারবে না। সে চিন্তা ভাবনা করে একটি উপায় খুঁজে বের করলো। সে তার বাড়ির কাছে একটি বড় গর্ত খনন করল যা তার সমাধির কাজ করবে এবং সেখান থেকে তার বাড়ির একটি ঘর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ খনন করলো।

তারপর সে সম্রাটের দরবারে ফিরে গিয়ে বললো –হুজুর, আমি প্রস্তুত, তবে আমার দুটি শর্ত আছে। বীরবল স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত শুনে রাজা এত খুশি হলেন যে,  তিনি ভুলে গেলেন যে বীরবল তার কাছে কিছুটা বিড়ম্বনাকর শর্ত রাখতে পারে।

– শীঘ্রই বল তোমার শর্তগুলি কী? আমি সেগুলি পূরণ করার চেষ্টা করব যাতে তুমি  আমার প্রিয় বাবার সাথে থাকতে তাড়াতাড়ি স্বর্গে যেতে পার।  

রাজার কথার উত্তরে বীরবল বললো -মহিমান্বিত, আমি আমার বাড়ির কাছেই সমাধিস্থ হতে চাই এবং আমি জীবিত অবস্থায়ই  সমাধিস্থ হতে চাই, যাতে আপনার প্রিয় পিতাকে আনন্দ দিতে আমি জীবন্ত স্বর্গে  পৌঁছতে পারি। 

রাজা এই প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত মনে করলেন এবং তত্ক্ষণাৎ তার প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করলেন। 

বীরবলকে তাঁর বাড়ির কাছে জীবন্ত কবর দেওয়া হল। বীরবল তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সুড়ঙ্গ পথে তার বাড়ীতে যেয়ে অবস্থান করতে শুরু করলো। এভাবে ছয় মাস কাটানোর পর বীরবল বড় দাড়ি আর বড় এলোমেলো চুল নিয়ে সন্তর্পণে প্রাসাদের বাইরে এসে দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাইলো।

তার দিকে তাকিয়ে আকবর কেঁদে উঠলেন। – তুমি কোথায় ছিলে বীরবল? বীরবল বললো –মহাত্বন, আমি আপনার প্রিয় পিতার সাথে স্বর্গে ছিলাম সেখানে আপনার বাবার সাথে আমার খুব ভাল সময় কাটিয়েছি। তিনি আমার সেবা নিয়ে এত খুশি হয়েছিলেন যে তিনি আমাকে পৃথিবীতে ফিরে  আসার বিশেষ অনুমতি দিয়েছেন। 

আকবর তার বাবার কথা জানতে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন -তিনি কি আমার জন্য কোনও বার্তা প্রেরণ করেছেন? 

-হ্যাঁ মহাত্বন, তিনি বলেছেন যে খুব কম নাপিত স্বর্গে যেতে পারে,  আপনি আমার দাড়ি এবং মাথা ভর্তি চুল দেখে এটি সহজেই অনুমান করতে পারেন। আর তাই তিনি           তাৎক্ষনিক আপনার নিজের নাপিতকে তাকে তার কাছে প্রেরণ করতে বলেছেন।

আকবর সব বুঝতে পারলেন। তিনি বীরবলকে একটি বড় পুরষ্কার এবং তার নাপিতকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। 

শিক্ষণীয়ঃ  অপরের ক্ষতির জন্য কুপরিকল্পনা করলে অবশেষে পরিকল্পনাকারীর নিজেরই ক্ষতি হয়। 

Category: Bangla, Moral Stories

Comment List

Your email address will not be published.