দৈবক্রম -১৫

 

 

এমনি এক সময় শাহেদ সরকারের নামে লোকাল একটা বাংলা পত্রিকায় ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন দেখে আশ্চার্য্য হলেন নাসিমা মন্ডল। ওদের বছর আটেকের পোতা ছেলের জন্য মধ্যবয়সী বাঙালী একজন গভর্নেস দরকার। ওদের ওখানেই থাকতে হবে তাকে।

এটা একটা অভাবনীয় সুযোগ হলেও অনন্যার জন্য এমন একটা কাজ নেয়া কষ্টকর হবে ভেবে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন নাসিমা মন্ডল। কিন্তু পুনরায় এ ব্যপারে একক সিদ্ধান্ত নিতে ভয় করলো তার।

অনন্যাকে দেখালেন তিনি পত্রিকাটি।

পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে নির্লিপ্তে বেশ কিছুক্ষন পড়লো বিজ্ঞাপনটি অনন্যা। এটাকে বিজ্ঞাপন না ভেবে বিধাতার পক্ষ থেকে ওর জন্য স্বচক্ষে সব কিছু যাচায়ের একটা সুযোগ বলে মনে হলো অনন্যার।

ও বাড়ী আর ওদের সবাইকে চেনে নাসিমা মন্ডল। পিতৃতুল্য মানুষ শাহেদ সরকার। তার স্ত্রী ছেলে বউ আর পোতাকে হারিয়ে মর্মবেদনাগ্রস্থ থাকে সব সময়। ওদের জীবন যেন থমকে আছে। যতটুকু চলা তা যেন ওই জামিলকে ঘিরে। আর জামিল যেন আরিফের ছোট বেলা।

বিস্তারিত সবই বললেন মেয়েকে।

ঠিক হলো অনন্যা ওর নিজের পরিচয়, নাসিমা মন্ডলের সাথে ওর সম্পর্ক ইত্যাদির কোন কিছুই গোপন করবে না। দেশ ছেড়ে ও একেবারে চলে এসেছে, ওর বিয়ের কথা হচ্ছে সবই বলবে ওদের আর বলবে এ কাজটা ও করবে বিয়ের আগ পর্যন্ত। বলবে ভায়ের সংসারে আছে, লেখাপড়া জানা মেয়ে তায় ভায়ের উপর বোঝা হতে চায় না।

নাসিমা মন্ডলের কথা উঠলে বিশেষ করে তার বর্তমান অবস্থানের কথা জিজ্ঞেস করলে মাঝামাঝি একটা উত্তর দেবে।

যে অংশটা গোপন করবে বা প্রয়োজন হলে মিথ্যে বলবে তা হলো আরিফের সাথে ওর বিয়ের কথাটা।

এ ভাবেই আরিফ অর্থাৎ ওর স্বামীর ছেলে জামিলের গভর্নেসের কাজটা নিল অনন্যা।

প্রথম দিন শাহেদ সরকার আর নাজমা বেগমের সাথে অনন্যার যাবতীয় কথাবার্তা শেষ হতে হতেই জামিল প্রবেশ করলো।

সাড়ে চার ফুটের একটু উপরেই হবে উচ্চতা, টকটকে ফরসা গায়ের রঙ, বড় বড় দুটো চোখ, একটু চ্যাপটা মুখোমন্ডলের উপর সরূ ছোট্ট নাকটা বসানো। চুলগুলো ছোট ছোট করে ছেটে দেয়াতে কান দুটো স্পষ্ট খাড়া দেখা যাচ্ছে।

হটাৎ করে নতুন কাউকে দেখে হতচকিত হরিন সাবকের মত বড় বড় চোখ করে অনন্যার দিকে তাকাতে তাকাতে একটু জড়ষঢ় হয়ে দাদুর গা ঘেসে দাড়ালো জামিল।

অবিকল আরিফ! অবাক হয়ে দেখছে অনন্যা।

আরিফ আর ওর মায়ের পছন্দ মত ওদের মেয়ে না হয়ে যদি ওর নিজের পছন্দ মত একটা ছেলে হতো তবে অবিকল এমনটিই হতো। অন্য কোন রকমই না।

-দাদু ভাই, এই যে তোমার নতুন আন্টি। যার জন্য তুমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলে। এখন থেকে ইনি আমাদের সাথেই থাকবেন।

-এখানেই থাকবে ইনি? নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করল জামিল।

-কেন, সন্দেহ হচ্ছে তোমার?

-আর যাবে না কখনো? একটু থেমে আবার প্রশ্ন করল জামিল।  

দাদুর কথা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না জামিলের।

-না, তুমি তাড়িয়ে না দিলে যাব না। তোমার জন্যই আমার চাকরী।

জামিলকে কাছে টেনে ওর চুল গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললো অনন্যা।

-না মা, এটাকে তুমি চাকরী বলো না। তুমি যে থাকতে চেয়েছো এটা সত্যিই আমাদের সৌভাগ্য। বড় ঘরের লেখাপড়া জানা মেয়ে তুমি। আমাদের কোন মেয়ে ছিল না, তবে মেয়ের মত বউমা পেয়েছিলাম। তার জাইগায়ই তুমিই না হয় থাকবে।

কথাগুলো বলতে বলতে শাড়ীর আচলে চোখ মুছলেন নাজমা বেগম।

-যাও দাদু ভাই ওকে উপরে নিয়ে যাও।

জামিল হাত ধরে অনন্যাকে নিয়ে উপরে গেল।

দোতলা বাড়ী। সামনে বুক অব্দি পাচিল ঘেরা ছোট একটা লন। পিছনের দিকেও কিছুটা খালি জায়গা। পশ্চিম দিক মুখ করা বাড়ীটার সামনে দিয়েই রাস্তা আর রাস্তার দুধার দিয়েই দাড়ানো প্রায় একই প্যর্টানের সব বাড়ী।

বাসার নিচ তলায় বেশ বড় একটা ড্রইং স্পেস সাথে লাগোয়া ডাইনিং তারই সাথে একটা হাত ধোয়ার বেসিন সাথে একটা বাথ। ডাইনিং স্পেসের একদিকে কিচেন আর অন্য দিকে একটা শোয়ার ঘর।

ড্রইং স্পেসের পাস দিয়েই দেয়াল ঘেসে উপরে উঠার সিড়ি। উপরে দুদিকে একটা করে দুটো বেড রূম এটাচড বাথ রূম সহ। সামনের রূমটার সাথে লাগানো একটা চিলড্রেন বেড।

উপরে পিছনের রূমটায় শাহেদ সরকার আর তার স্ত্রী থাকেন। সামনের দিককার রূমটাতে অনন্যাকে নিয়ে আসলো জামিল।

ঘরে ঢুকেই জামিলকে বুকে জড়িয়ে আদর করলো অনন্যা। মাতৃহারা জামিলও মায়ের আদরের উষ্ণতায় চুপ করে রইলো।

হায়রে নিয়তি, কে জানে কি নতুন খেলা শুরূ করলো ওকে নিয়ে! অশ্রুসিক্ত চোখে ভাবলো অনন্যা।

খাটের উপর জামিলকে বসিয়ে অপলক নেত্রে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো অনন্যা।

অনেক কথা বলে জামিল। কোন সময় দেশের কথা আবার কোন সময় লন্ডনের কথা, একটার সাথে আরেকটা মিসিয়ে ফেলে। বড় দাদু, ছোট দাদু, বড় দাদিমা, ছোট দাদিমা, বড় পাপা, ছোট পাপা একটার সাথে আরেকটা জড়িয়ে ওর মত ও বলতেই থাকে।

ওর কথার সবটা বুঝতে পারে না অনন্যা। কিছু জিজ্ঞেস করে ওর কথা বলার গতিকে থামিয়ে দিতে একদম মন চায়লো না অনন্যার। আর ওকে নিবিড় ভাবে দেখতে দেখতে ওর কথার পুরোটা কানেও গেল না অনন্যার।

অনন্যা আরিফকে দেখেছে শুধু ওই চার দিনের জন্য। কিন্তু ওই চারটা দিন জীবনের অন্য চার দিনের মন সাদামাটা ছিল না। ওই চার দিনের প্রতিটি মুহুর্ত বারবার চোখের সামনে এনে পরীক্ষা করেছে অনন্যা। তায়তো ওই চারটা দিন ওর স্মৃতিতে চির জীবন্ত।

জামিলের হাটা চলা কথা বলা সব কিছুতেই আরিফের উপস্থিতি। জামিলকে তন্ময় হয়ে দেখছিল অনন্যা।

উপরে উঠে পর্দা টানা দরজার সামনে থমকে দাড়িয়ে ঘরের ভিতর থেকে আসা জামিলের অনর্গল কথাবার্তা দাড়িয়ে শুনছিলেন শাহেদ সরকার আর নাজমা বেগম। ঘরটা গমগম করছে আবার ঠিক আগেকার মত যখন ওদের ছেলে বউ থাকতো ও ঘরে।

ওরা মারা যাওয়ার পর থেকে খালিই থাকে ওপাশটা।

আজ মনে হচ্ছে ভরে গেছে ওপাশটা। মনে হচ্ছে যেন ফিরে এসেছে ওরা।

মাকে টেলিফোনে সব জানালো অনন্যা।

জামিল ওর বই খাতা বিছানা খেলনা সব এক এক করে নিয়ে আসলো এ ঘরে। জানালো আজ থেকে এ ঘরেই থাকবে ও। ওর সব কিছু সযত্নে গুছিয়ে দিল অনন্যা।

ঘরে ঢুকে ভারী খুশী হলেন নাজমা বেগম। আগে ঢুকলে বুকটা কেমন খালি খালি লাগতো। আজ সব কিছুই সেই আগের মত করে সাজানো।

-আমার বৌমাও এমনি করেই সব গুছিয়ে রাখতো।

টেবিলের উপর একটা ফ্রেমে ছেলে বউ ওদের কয়েকদিন বয়সের বাচ্চা সহ শাহেদ সরকার আর নাজমা বেগমের একটা ছবি ছিল। মাহিম আর ওর স্ত্রী ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ছবিটা ওই টেবিলের উপর রাখা ছিল।

ছবিটা ওদের সবারই খুব প্রিয় কারণ ওটার একটা বিশেষত্ব ছিল।

হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে যেদিন প্রথম আসলো সেদিনই তোলা ছবিটা। মাহিমই প্রস্তাবটা করলো -ঘরে প্রবেশ করার আগেই ওর ছেলের সাথে সবাই মিলে ছবি তুলবে।

বাসার কাজের ছেলেটাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে বলা হলো সব ঠিক হলে রেডি বলার পর ও যেন বোতামে টিপ দেয়। গোল বাধলো বাচ্চা কার কোলে থাকবে। তা নিয়ে রিতিমত কাড়াকাড়ি। আর ওই মুহুর্তে রেডি বলার আগেই বোতামে টিপ দিল কাজের ছেলেটা। ফ্লাস জ্বলে ছবিটা উঠতেই অটো ক্যামেরার রিল শেষ হয়ে রিওয়াইন্ড হতে শুরূ করলো।

ওয়াস করার পর সবারই পছন্দ হলো ওই ছবিটা।

বৌমা বলেছিল- মা লক্ষ করেছেন ছবিটা যেন কথা বলছে।

বৌমা আর মাহিম দুজনেই পছন্দ করে ছবিটা বাধিয়ে আনলো। কিন্তু আবার গোলটা বাধলো ছবিটা কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে।

মাহিম চায় ছবিটা বেড সাইড টেবিলে থাক আর বৌমা চায় ওটা দেয়ালে টাঙাবে। ছবিটা আপাততঃ সাইড টেবিলে রাখা হলো।

ওটাকে দেয়ালে টাঙানোর জন্য দেয়ালে ছিদ্র করে পেরেকও বসালো বৌমা। যাওয়ার আগ মুহুর্তে বললো- তাড়াহুড়ো থাকায় দেয়ালে ছবিটা টাঙানো হলো না, তবে বলে রাখছি মা আমি ফিরেই ওটা দেয়ালে টাঙাবো।

ছবির ফ্রেমটা টেবিলেই রয়ে গেল।

আজ ছবিটা টেবিলে না দেখে নাজমা বেগম একটু অবাক হলেন। তাকাতেই দেখলেন ছবিটা দেয়ালে টাঙানো।

অনন্যা বুঝলো ছবিটা সরানো চোখে পড়েছে নাজমা বেগমের।

-ছবিটা দেয়ালেই মানাচ্ছে ভালো। দেখলাম ওখানে টাঙানোর জন্য পেরেকও পোতা আছে তায় টাঙিয়ে দিয়েছি।

নাজমা বেগম একদৃষ্টে তাকিয়ে অনন্যার দিকে। -ছবিটা সরানো বোধহয় ঠিক হয়নি। এদের ছেলে বউ আর পোতা দুর্ঘটনায় হারানোর ব্যপারটা অনন্যা আগেই শুনেছিল মায়ের কাছ থেকে। ছবিটা যে তাদেরই সেটা বুঝেছিল অনন্যা। কিন্তু এতকিছু না ভেবেই ছবিটা সরানো বোধহয় ঠিক হয়নি। ভাবলো অনন্যা।

-আমার ভূল হয়ে গেছে।

কথাটা বলে অনন্যা ছবিটা দেয়াল থেকে সরানোর উদ্দোগ নিতেই নাজমা বেগম সযন্তে অনন্যার মাথায় হাত রেখে ওকে থামিয়ে দিলেন।

-না ওখানেই থাক ওটা। বউমা ওটা ওখানেই টাঙাতে চেয়েছিল ফিরে এসে। দেখছো না পেরেকটা পোতায় ছিল।

ঠিক কি করবে বা বলবে তা বুঝে উঠতে পারলো না অনন্যা।

-ছবিটা মনে হয় কথা বলছে। সবাই কথা বলছে, এমনকি বাচ্চাটাও। একটু ইতস্ততঃ কণ্ঠে বললো অনন্যা।

ওর মন্তব্যে চমকে উঠলেন নাজমা বেগম। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অনন্যার দিকে।

-বড় দাদিমা আজ থেকে আমি আন্টির সাথে ঘুমাবো।

জামিলের মাথার চুলের ভিতর আঙ্গুল বুলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নাজমা বেগম।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.