রাজার খেলা

 

 

 

 

বাঘের খাচার ঢাকনাটা ধীরে ধীরে উঠে গেল। পিলে চমকানো বাঘটা ওর রাজকীয় দেহযষ্টি প্রদর্শন পূর্বক নিঃশব্দে বেরিয়ে আড় চোখে বিশাল দরবার রুমের মধ্যে উপবিষ্ট সকলকে দেখে নিল এক নিমিষেই।   

ওকে দেখে উপবিষ্ট সবাই নড়ে চড়ে সতর্ক হয়ে বসলো।

এটা রাজার দরবার। তার দরবারে তিনি ছাড়া সবাই প্রজা।

সম্মুখে সবাই সতর্ক হয়ে সভায় উপবিষ্ট। তারকা খচিত সিংহাসনে বসে আছেন রাজা। পাশে ডোরা কাটা একটা নাদুস নুদুস হরিণ সাবক বসে কচি কচি ঘাস চিবুচ্ছে।

রাজার ক্ষুধার্ত বাঘটা প্রতিদিন ওর ইচ্ছানুযায়ী খুশিমত বেছে বেছে মানুষ ধরে খায়। ছোট বড় বৃদ্ধ কোন বাদ বিচার নেই।

এটা এ রাজ্যের রাজার খেলা। প্রজাদের কেউ রাজার এ খেলা পছন্দ করুক আর না করুক তাতে রাজার কিছু আসে যায় না। এ রাজ্যে বাস করতে হলে রাজার এ খেলায় সবাইকেই অংশ নিতেই হয়।

ভারী খেয়ালী বাঘটা- ছোট বড় পুরুষ বা মহিলা কোনটা কখন ওর পছন্দ বা কখন যে ওর ভরা পেট আর কখন যে খালি তা বোঝার কোন উপায় নেই।

রাজা প্রতিদিনই তাঁর সিংহাসনে বসেন তাঁরই নিয়মানুয়ায়ী। আর রাজ্যের সবাইকে দরবারে হাজির হতে হয় বাঘের বাছায়ের জন্য। এটাই এ রাজ্যের নিয়ম।

রাজার ইশারায় ঠিক সময় মত বাঘের খাচার মুখ খুলে যায়। ধীরে ধীরে রাজকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে বাঘটা। তাকায় সবার দিকে। তারপর খেয়ালমত কখনো অধৈর্য ভাবে লাফ দিয়ে আবার কখনো ধীরে সুস্থে; কোন সময় হয়তো একজন, আবার কোন সময় কয়েকজনের ঘাড় মটকে দেয় একসাথে। 

বাঘের মন মেজাজের উপর নির্ভর করে কখনো কখনো ওর মরন থাবা থেকে অনেকে অক্ষত বা কিছু ক্ষত নিয়েও প্রাণে বেচে যায়।

সেদিন কমল আর কামাল দুজন পাশাপাশি বসে একদম সামনের সারিতে। ওদের দিকেই আসছে বাঘটা। সাধারণ মানুষ ওরা। এ রাজ্যের অন্য সকলের মত বাঘটা সম্পর্কে জানে ওরা দুজনেই দূর থেকে দেখেছে অন্যদের ধরে খেতে। কিন্তু এত কাছ থেকে সামনা সামনি ওরা কেউই বাঘটাকে দেখেনি এর আগে কখনো।

দুজনেই ভীত সন্ত্রস্থ কিছুটা জড় ষড় হয়ে বসে। যেন বাঘটার দৃষ্টি ওদের উপর না পড়ে সেই প্রচেষ্টায়রত।

বাঘটা ওদের দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই কামাল চমকে নিজের অজান্তে লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালো। আর তাতে ভয় পেয়ে রাজার গা ঘেসে বসা নাদুস নুদুস হরিণ শাবকটা দিকবিদিক জ্ঞানশুণ্য হয়ে লাফ  দিলো।

বাঘটা তখন ওদের একেবারে সন্নিকটে। যাকে বলে সাক্ষাৎ যম! থাবাটা এগিয়ে দিলেই ওদের ঘাড়টা একদম নাগালের মধ্যে।

কিন্তু ভাগ্যের কি জোর ওর! হরিণ সাবকটাকে সামনে পেয়েই বাঘটা বোধহয় লোভ সামলাতে পারলো না। ওটার কচি ঘাড়টা এক কামড়ে মুচড়ে নিয়েই মুখ ঘুরিয়ে খাচার দিকে চলে গেল।

আদরের হরিণটার এই অকাল মৃত্যুতে পরিষদবর্গ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো। পাইক পেয়াদারা কামালকে আটক করে বিচারের জন্য সোপার্দ করলো। বিচারে কম করে যাবত জীবন সশ্রম কারাদন্ড হবে বলে বললো সবাই।

এদিকে সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে অলৌলিক ভাবে রক্ষা পেয়ে ঘটনার আকষ্মিকতায় বিহবল হয়ে রইলো কমল। হরিণ সাবকটা যেন বিধাতার হাত হয়ে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বাচালো ওকে।

সব কিছু অতিপ্রাকৃত আর নিজেকে অতিমানবিক মনে হতে লাগলো কমলের।

দৃশ্যটা ওকে তাড়া করে ফিরতে লাগলো সারাক্ষন। দৈনন্দিন কোন কিছুতেই মন বসাতে পারলো না। ওর সবকিছুতেই একটা অলৌকিকতার ছোয়া বোধ করতে লাগলো কমল। ওর মনে হতে লাগলো ও যেন প্রকৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

গাছের পাতা নড়া, পাখীর ডাক এ সব কিছু কমলের কাছে বিশেষ অর্থবোধক হিসাবে পরিগণিত হতে লাগলো। অবশেষে কমল প্রকৃতির অংশ হওয়ার অভিপ্রায়ে সব মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে একেবারে জঙ্গলে আশ্রয় নিল।

প্রথম কিছুদিন শরীরে গাছের লতা পাতা জড়িয়ে মাথায় ঘাস পাতা বেধে পশু পাখীর সাথে একান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। তারপর একদিন পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে নিজের দেহের সব আকৃতি লুকিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে পশু পাখীর মত নীরিহ ভাবে জীবন অতিবাহিত করার ব্রত গ্রহন করলো কমল।

অন্য দিকে বেচারা কামাল বিনা অপরাধে জেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। কিন্তু বিনা দোষে জীবনটা এভাবে শেষ হয়ে যাওয়াটা কামাল মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না।

দিনে দিনে ওর মনের ভিতর ক্ষোভ জমে জমে একটা প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। অবশেষে নিজের উপর সব নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো কামাল। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে দুজন প্রহরীকে প্রতিহত করে জেল ভেঙে পালালো কামাল।

ও এখন জেল থেকে পালানো ফেরারী আসামি। ধরা পড়লে নির্ঘাত ফাসি। তায় যতদিন পালিয়ে থাকা যায় আযুটা ততোদিনের।

কামাল এখন নিজের মনের কাছেই অপরাধী। কিন্তু ও যা কিছু করেছে তা কেবল জীবন বাচানোর জন্য। আর এ অবস্থায় জীবনটা বাচানোর জন্য যা দরকার তার সবকিছু করবে ও।

ওর নিজের সাথে যে কোন হিংস্র পশুর তুলনা করা যায়। ভাবলো কামাল।

জীবন বাচানোর তাগিদে কামালও একদিন সভ্য জগত ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিল। আর হিংস্র পশুর সাথে নিজের আকৃতিগত পার্থক্যটুকু মুছে ফেলার জন্য সেও একদিন পশুর চামড়া গায়ে পরলো।

নিয়তির খেয়ালে কামাল আর কমল মনুষ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গলে বসতি গাড়লো। ওরা কেউই এখন আর সভ্য সমাজের বাসিন্দা হয়ে রাজার দরবারে হাজির হয় না রাজার বাঘের খাদ্য হিসাবে।

কামাল আর কমল দুজনই মানুষের ভাল আর খারাপের দুদিকের সীমানা অতিক্রম করে দুই মেরুতে অবস্থান নিল।

বাঘের চামড়ায় আবৃত কামাল পশুর হিংস্রতা আর মানুষের বুদ্ধিমত্তার মিশ্রন ঘটিয়ে সত্যি বলতে বনের অন্যান্য হিংস্র জানোয়ারদের কাছেও ত্রাসের বস্তু বলে পরিগণিত হলো।

অন্যান্য সব হিংস্র পশুরা শিকার করে জাত পাট বিচার করে ক্ষুধা নিবারণের জন্য। কিন্তু ও শিকার করে প্রতিহিংসা চরিতার্থে। তায়তো কোন পশুই ওর হাত থেকে রেহায় পায় না। বাঘরুপী কামাল শিকার করে বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে। তায় অন্যান্য বাঘরাও ওর সাথে পেরে ওঠে না।

অন্যদিকে হরিণের চামড়ায় আবৃত কমলও কেবল আকৃতিগত বা স্বভাবগত কারণেই নিরিহ না। হিংস্র পশুদের হাত থেকে শুধু নিজেকে বাচিয়েই পরিতৃপ্ত হয় না কমল। অন্যান্য সবাইকে বাচানোর মধ্যেই তৃপ্তি ওর। আর সে কাজ করতে সেও তার মনুষ্য বুদ্ধি বিবেচনা কাজে লাগাই এমনকি মাঝে মধ্যেই নিজের জীবনের ঝুকিও গ্রহন করতে দ্বিধা বোধ করে না।

শুধু হরিণদের সাথেই না জংগলের অন্যন্য সব নিরীহ পশু পাখীদের সাথেও ওর ভাব। মাঝে মধ্যেই নিজের লম্বা শিং দুটোয় নানা গাছের ছোট ডাল পাতা বেধে গাছের মত দাড়িয়ে থাকে আর তার উপর এসে বসে সব পাখীর দল ঝাকে ঝাকে। কমল তখন প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্দ অংশ হয়ে তৃপ্তিতে চোখ দুটো বন্দ করে।

কামালের বুদ্ধিমত্তা আর চরম প্রতিহিংসা পরায়নতার কারণে ওর হাতে অযথাই নীরিহ প্রাণীরা জীবন দিতে লাগলো। অন্যদিকে কমলের পরোপকারী মনোভাব আর বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্বে অন্যান্য মাংসভোজী প্রাণীরা শিকার ধরতে না পারাতে দিন দিন না খেতে পেয়ে শুখিয়ে মরতে লাগলো। অন্য দিকে কিছুদিনের মধ্যেই হরিণের সংখ্যা অনেকগুনে বৃদ্ধি পেয়ে জংগলে ওদের খাদ্য উপযোগী ঘাস পাতার অভাব দেখা দিল।

কেউ সঠিকভাবে বুঝলো না কেন এমন হচ্ছে। জংগল থেকে সকল সুখ শান্তি যেন বিদায় নিল। কেবল মাত্র কামাল আর কমল তৃপ্তি সহকারে তাদের মনোবাসনা নিবৃতি করতে লাগলো।

বনের পশুরা সবাই কায়মনোবাক্যে সব কিছু আগের মত হওয়ার আশা পোষন করতে লাগলো।

একদিন বায়ু কোণে মেঘ করলো। কালো কুচকুচে মেঘ। নিমেষেই দমকা বাতাস তা ছড়িয়ে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেললো। বেলা না গড়াতেই অন্ধকার ঢেকে ফেললো পুরো জঙ্গল। রাত হয়েছে ভেবে পশুরা সব আশ্রয় নিল নিজ নিজ আস্তানায়।

কামাল আর কমল কেবল বুঝলো এ স্বাভাবিক রাত হওয়া নয়, মহাপ্রলয়ের সংকেত। শঙ্কিত হয়ে উঠলো ওরা।

শুরু হলো প্রলয়। ঝড়ে সব ভেঙ্গে লন্ডভন্ড করতে লাগলো। আর অবিরাম বর্ষন সব কিছুকে ভাসিয়ে নিতে লাগলো। প্রকৃতি যেন ধ্বংসের উম্মত্ততাই ফেটে পড়লো।

বন্য পশুরা জীবন বাচাতে তৎপর হয়ে উঠলো। তারা এ জংগল ছেড়ে দূরে অন্য কোন গভীর জংগলে আশ্রয় নেয়ার জন্য ধীরে ধীরে দলে দলে জংগল ছেড়ে চলে যেতে লাগলো।

কামাল আর কমল ভাবলো কি বোকা ওরা সবাই, ভাবছে বোধহয় ওখানে ঝড়বৃষ্টি নেই। ওরা চিৎকার করে ডেকে ওদের সে কথা বুঝিয়ে নিবৃত করতে চায়লো।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে নতি স্বীকার করে রাতের আধারেই সব পশুরা বন উজাড় করে চলে গেল। কামাল আর কমলের শত অনুরোধ ওদেরকে নিরাস্ত্র করতে পারলো না।

ভোরের আলো ফুটতেই প্রকৃতির ছোবল চোখে পড়তে লাগলো। চমকে উঠলো ওরা। এখানে সব একেবারে লন্ডভন্ড, সমতল বলতে যা বুঝায় তার সব পানির নিচে। কেবল পাহাড়গুলোর মাথা আর বড় বড় গাছের আগাগুলো কোন রকমে নাক উচু করে দাড়িয়ে আছে।

এতদিনে এই প্রথম লোকালয়ের সবার কথা মনে পড়তে লাগলো ওদের। না জানি কি অবস্থা সেখানে সবার।

কামাল একটা পাহাড়ের মাথায় আশ্রয় নিয়েছে।

অন্যদিকে কমল একটা ভাষমান গাছের গুড়ির উপর উঠে কোন রকমে জীবন বাঁচালো। ওর সাথে একটা ছোট্ট হরিণ সাবকও দাড়িয়ে। বেচারা বোধহয় দুর্বল হওয়াতে মায়ের সাথে যেতে পারিনি।

ওদের গুড়িটা ভাসতে ভাসতে কামালের পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই ওদের সেদিকে নজর পড়ায় দুজনেই ভীত হয়ে মনের অজান্তে ঢোক গিললো।

মনে হচ্ছে ক্ষুধার্ত বাঘটা থাবা বাড়িয়ে ধরে ফেলবে ওদের।

গাছের গুড়িটা বাঘের পাহাড়ের কাছ দিয়ে ভেষে যাওয়ার সময় হটাৎ করে কেউ কিছু বউঝে ওঠার আগেই কমল ধাক্কা দিয়ে হরিণ সাবকটাকে পাহাড়ের গায়ে ফেলে দিল। যাতে বাঘটা খাবার পেয়ে ওকে রেহাই দেয়।  

একেবারে সামনে সাক্ষাৎ যমদুতকে দেখে হরিণ সাবকটা ভয়ে জড়ষড় হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনতে লাগলো।

হরিণ সাবকটাকে পেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘটা হয়তো ওকে রেহায় দেবে তা ভেবে কমল একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

ক্লান্তি আর ক্ষুধায় আধমরা হরিণ সাবকের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে ভারী মায়া হলো কামালের। ওকে অভয় দেয়ার জন্য ও সরে একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো।

তা দেখে অবাক হলো হরিণ সাবক আর কমল দুজনেই।

অভয় পেয়ে কমলও লাফ দিয়ে গাছের গুড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের মাথায় আশ্রয় নিল।

ঝড় বৃষ্টি থামলো, ধীরে ধীরে পানি নেমে আবার ভেষে উঠতে শুরু করলো সব কিছু।

কিন্তু চারিদিকে  কেবল শুন্যতা। ওদের মনটা হাহাকার করে উঠলো। এতদিনের সব হিসেব যেন গড়মিল হয়ে যেতে লাগলো।

বেচারা হরিণ সাবকটির জন্য ওর আপনজনদের কাউকে না আসতে দেখে অবাক হলো ওরা। আরো অবাক হলো আপনজনদের জন্য ওর মধ্যেও তেমন কোন অনুভূতি না দেখে।

পশুত্ব আর দেবত্বের দুই মেরুর মাঝামাঝি জায়গাই সব মানুষের অবস্থান। ক্ষেত্র বা পরিস্থিতির কারণে তারা পশুত্ব বা দেবত্বের দিকে ঝুকে পড়ে কেবল কিন্তু কোন দিকের সীমা অতিক্রম করতে পারে না।  

লোকালয়ে ফেলে আসা অন্যান্য সকলের জন্য মনটা আনচান করে উঠলো কামাল আর কমলের। ভাবলো প্রতিদিন রাজার দরবারে বসা আর তাঁর বাঘের ইচ্ছানুযায়ী ওর ধারালো নখের আচড়ে জীবন দেয়ার জন্যই ওদের জন্ম।

এ যে রাজার খেলা!

Category: Meaning of Life, Posts

Comment List

Your email address will not be published.