অংকের হিসাব

 

 

কিছুক্ষণ পূর্বে অফিস শুরু হয়েছে। অমর আমার এ্যাসিস্টেন্ট আজ এই মুহুর্তে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। উৎকণ্ঠায় ভরা ওর মনটা। তবে ওর নিজের কোন বিষয়ে নয়, আমার জন্য।

গত প্রায় এক যুগ ধরে একটা আন্তর্জাতিক সেবামুলক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছি। প্রথম থেকেই আমার এ্যাসিসট্যাণ্ট হিসেবে কাজ করে অমর। গত প্রায় বিশ বছর ধরে ঐ একই পদে চাকরী করছে ও।

আমার কাজ কিছুটা তথ্যভিত্তিক এবং গবেষণামুলক। ‘সাহায্য কর যেন সে নিজেকে সাহায্য করতে পারে’ এই মটো নিয়ে কাজ করে আমাদের কোম্পানী। যেমন সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন টার্গেট পপুলেশান সনাক্ত করে তাদের সম্পর্কে নানাধরণের তথ্য সংগ্রহ পূর্বক নথিভূক্ত করা। তারপর সেবাদান পরবর্তি রেজাল্ট সম্পর্কে পূর্বাভাষ তৈরী করা ইত্যাদি।

একটা বিশেষ প্রকল্পের জন্য মাঠকর্মী কর্তৃক সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্যগুলো শ্রেণীবিন্যাস করার প্রক্রিয়াই সরেজমিনে কিছু তথ্য যাচাই বাছাই করার জন্য প্রায় প্রতিদিনই সকালে অফিসে হাজিরা দিয়ে চিঠি পত্রগুলো কোন রকমে দেখেই মাঠে বেরিয়ে পড়ি। বলতে গেলে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরই বেশ রাত অব্দি অফিসের কাজগুলো করতে হয়। আর আমার এ্যাসিস্টেন্ট কোন অভিযোগ বা অনুযোগ বাদেই প্রসন্ন বদনে আমার সাথে কাজ করে।

এই চাকরীটাতে ওর কোন প্রমোশন নেই তবে নির্দিষ্ট সময়ের পর বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা আছে। প্রমোশানের ব্যাপারে ওকে কখনো কোন আক্ষেপও করতে শুনিনি। কারণ এই চাকরীটা পাওয়া ওর একটা স্বপ্ন পুরনের মত।

পাঁচটা ছেলে মেয়ে নিয়ে ওর সংসার, বলতে গেলে ওর পরিবারটা পুরোপুরিই এই চাকরীর উপর নির্ভরশীল। অমর সৎ মায়ের সংসারে মানুষ। ওকে জন্ম দিয়ে দু বছর হতে না হতেই ওর মা মারা যায়। বাবার সম্পত্তি বলতে বসতবাড়ীর কাঠা দুই জায়গা ছাড়া আর কিছুই পায়নি ও।

অমরের বড় ছেলেটা ক্লাস এইটে পড়ে। তারপরের ছেলেমেয়ে গুলো এক দুই ক্লাস করে নিচের দিকে। একটায় মেয়ে তিন নাম্বারে। ওকে নিয়েই বেশী চিন্তা অমরের। ওর মতে মেয়েটা সবার বড় হলে ভালো হতো। তা হলে এতদিন বিয়ের একটা ব্যবস্থা করতে পারতো।

ছেলে মেয়ে সবাই সরকারী স্কুলে পড়ে। ছেলে গুলোকে ম্যাট্টিক পাশ করাতে পারাটাই ওর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য।

-ম্যট্রিক পাশের সর্টিফিকেটের জন্যই চাকরীটা আমার হয়েছে স্যার! এধরনের আলোচনাকালে অমর প্রায়শই কথাটা বলে অমর। কথাটা বলার সময় ও অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। ছেলেদেরকে ম্যট্রিক পাশ করানোর ব্যাপারে ওর একটা অদ্ভূত ধরনের ভাবাবেগ আছে।

আমার কাজ থাকে তাই আমি বেশ রাত অব্দি অফিসে থাকি। আমি অফিসে থাকা পর্যন্ত ও বাড়ি যায় না।  অত রাত পর্যন্ত  আমার জন্য অফিসে বসে না থাকার জন্য মাঝে মধ্যে ওকে বলেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি তাতে।  

এই চাকরীটা সম্পর্কে ওর অদ্ভূত একটা নিজস্ব মানষিকতা আছে। ওর কথায় বোঝা যায় এই চাকরীটা ছাড়া ওর বেচে থাকবার আর কোন অবলম্বন নেই। অমর বলে এই চাকরীটার জন্যই ও বিয়ে করে সংসার করছে। চাকরীটাকে স্বরন করে ও আর ওর স্ত্রী প্রতি সকাল সন্ধায় ঠাকুর ঘরে প্রদিপ জ্বালায়। চাকরীটা না হলে ওর জীবনের গল্পটায় হয়তো অন্যরকম হতো।

আজ সকালে অপ্রত্যাশিতভাবে অফিসের বস মিশেল অফিস শুরু হওয়ার পূর্বেই আমাকে তার অফিসে জরুরী তলব করায় আমার কোন বড় ধরণের সমস্যা হলো কিনা এটায় ওর উৎকণ্ঠার কারণ।

সকালে অফিসে আসতেই অমর জানালো কথাটা। মিশেলের অফিস সহকারী সংবাদটা দিয়ে গেছে।

মিশেল ফ্রান্সের বাসিন্দা। গত প্রায় পনেরো বছর ধরে কাজ করছে এখানে। অফিস গুরু হয় সকাল দশটায় কিন্তু তার বেশ আগেই মিশেল অফিসে চলে আসে। রুটিনের যেন কোন হের ফের হওয়ার নয়। এসেই ও বেরিয়ে পড়ে পাচিল ঘেরা অফিস এরিয়াটা ঘুরে দেখতে, সমস্ত অফিস বাগান ইত্যাদি। কর্মরত যাকেই পায় তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে। সবাইকে নামে চেনে মিশেল। এমনকি পরিবার ও ছেলেমেয়ে সম্পর্কেও খোজ খবর নেয়।

প্রতিদিন আমি আসার আগেই অমর অফিসে আসে। আমার অফিস খোলা আর ঝাড়ামোছার কাজটা ওই করে। তারপর আমি আসার আগে সব চিঠিপত্রগুলো খুলে সেগুলো রেজিষ্টারে উঠিয়ে ওর মন্তব্য লিখে দশটার মধ্যেই আমার টেবিলে রাখে।

সকালে রোজই মিশেলের সাথে দেখা হয় অমরের। অত্যন্ত পছন্দ করে মিশেল ওকে, ওর কাজে আন্তরিকতার জন্য।

দেখা হলে মিশেল ওর ছেলেমেয়েদের নাম ধরে তাদের খোজখবর নেয়।

আজ সকালে মিশেলের সাথে ওর দেখা হয়নি। একটু অবাকই হয়েছিল অমর। কিন্তু ওর বুকের ভিতরটা কেপে উঠলো, যখন দশটার একটু আগে মিশেলের অফিস সহকারী এসে আমি আসার সাথে সাথেই মিশেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য অমরকে বলে গেল।

অমর আমার অফিসের দরজায় দাড়িয়ে ছিল। গাড়ী থেকে নামতেই হন্তদন্ত হয়ে খবরটা আমাকে দিল।

একটু অবাকই হলাম। মিশেলের সাথে জরুরী দেখা করার তলবের জন্য যতটা নয় তার চেয়ে বেশী অমরের উদ্বিগ্নতায়।

অফিসের মধ্যে পায়চারি করছিলো মিশেল। ভীষণ বিরক্ত মনে হলো ওকে। আমি প্রবেশ করতেই পায়চারি থামিয়ে তাকালো আমার দিকে। হাতে ধরা একটা খাম।

-অন্য কেউ ব্যাপারটা জানে না।

ছোট একটা নি:শ্বাস টেনে মিশেল পুনরায় বললো।

-অমর আমাদের অফিসের একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী। ওর পুরো পরিবারটা এই চাকরীর উপর নির্ভরশীল। তদন্ত করে আমাকে জানিও।

– এটা একটা অভিযোগপত্র, মানুষ এত নিষ্ঠুর!

একটা দীর্ষ নি:শ্বাস ফেলে খামটা আমার হাতে দিতে দিতে বললো মিশেল। 

আমি অফিসে ফিরে আসলাম। চেয়ারে বসে চিঠিটা পড়ে শেষ করতে না করতেই অমর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার সামনে দাড়ালো।

-স্যার আপনার কোন অসুবিধে হয়নিতো!

আমার অসুবিধার জন্য অমর, আমার এ্যাসিস্টেন্ট উদ্বিগ্ন। কারণ ওর মতে আমার মত ভাল একটা মানুষ নাকি ওর চোখে খুব একটা পড়েনি।

ওকে খুব পছন্দ করি আমি বিশেষ করে ওর সরলতার জন্য।  কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওর সাথে অনেক কথা হয় আমার। জীবিকার কথা, জীবনের কথা।

অমর একদিন কথার ফাঁকে একটা গল্প বলেছিল। সেদিন গল্পটার অর্থ আমি পরিষ্কার বুঝিনি। 

অমর তখন ক্লাস টেনে পড়ে। বাবা কিছুতেই বোর্ড পরীক্ষার ফিস যোগাড় করতে পারলো না। চোখে জল নিয়ে ও বাবার কাছে গেল, বাবা তার অসহায়ত্বের কথা জানালেন। সেদিনই জীবনটা থেমে গিয়েছিল অমরের।

মনটা ভীষণ খারাপ। ভগ্নহৃদয় অমর ওর বাড়ীর অদূরে অবস্থিত জমিদার বাড়ীর খামারের সাথে জঙ্গলটার মধ্যে একটু ফাকা জায়গায় যেয়ে বসলো।

জঙ্গলটা জমিদারের। আশে পাশের দরীদ্র মানুষের চুরী চামারীর থেকে বাচার জন্য এই জঙ্গলটার ভিতর জমিদার তার ধানের বিশাল চাতাল তৈরী করেছে।

গ্রীস্মের ঘুঘু ডাকা নীরব দুপুর, গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। মধ্যবয়সী কয়েকজন কাজের মহিলা ধান রোদে বিছিয়ে চাতালের ধারে গাছের ছায়ায় বসে পাহারা দিচ্ছে। পাখী তাড়ানোর জন্য বাশ দিয়ে তৈরী একটা পটকা লাগিয়ে রশি টেনে ওদের বিশ্রামের জায়গা পর্যন্ত লম্বা করে এনেছে। ক্লান্ত হয়ে গাছের ছায়ায় বসে দড়ি টেনে পটকা বাজিয়ে পাখি তাড়াচ্ছে।

ওদের ক্লান্তিভরা শরীরগুলো গাছের শীতল ছায়ায় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে মানুষগুলো।

এই সুযোগে পাশের গাছ থেকে একটা শালিক নেমে এসে ধানের উপর বসলো। তাকালো এদিক ওদিক কিছুক্ষন। চুরী করার জন্য কোন বিবেকের তাড়না নয়, জীবনের ভয় বোধহয়।

তারপর ঠোটে করে কিছু ধান নিয়ে উড়ে গিয়ে গাছে বসলো। ওর আনা খাবারের গন্ধে বাচ্চাগুলো কিচিরমিচির করে উঠলো। বাসাটা দেখা যাচ্ছে। পরম তৃপ্তিতে মা পাখিটা খাবারগুলো ডানা ঝাপটানো বাচ্চাদের মুখে পুরে দিচ্ছে পরম আত্মতৃপ্তিতে।

আরো কয়েকবার এমনিভাবেই উড়ে উড়ে খাবার নিয়ে গেল মা শালিকটা।

জমিদারের বিরাট ধানের গাদা, মনে হয় অফুরন্ত ভাণ্ডার, দুচারটে দানা বিশাল সমুদ্রের জলরাশির  একফোটা জলের তুলনায়ও নগন্য। কিন্তু এই দু একটি ফোটা কারো জীবন বাচাতে পারে আবার কারো বা জীবিকার তাগিদ মেটাতেও যথেষ্ঠ।

এই বিশাল জলরাশি পরিমান সম্ভারগুলো জমিদারের জন্য গোজগাজ করতে ক্লান্ত মানুষগুলো প্রকৃতির টানে তারই কোলে ঘুমন্ত। 

ফাঁকি দেয়ার কোন মানষিকতায় নয়, প্রকৃতির কাছে পরাভূত ওরা।

প্রকৃতির কাছে পরাভূত শালিক পাখীটা আর ওর বাচ্চাগুলোও – ক্ষুধা নিবারণ!

কারো মধ্যে কোন অপরাধ বোধ নেই! না মানুষের না পাখীর। ওরা সবার কার্যকলাপই প্রকৃতির তাড়নার ফল, তায় প্রকৃতির চোখে ওরা অপরাধী নয়।

মহাপরাক্রমশালী প্রকৃতি রচিত খেলায় রত সবাই ওরা।

খেয়ালী প্রকৃতি তাঁর খেয়ালের কোন ব্যাখ্যা দেয় না। অংকের নিয়মে ব্যাখ্যা করতে প্রকৃতির যত অনীহা।

অসীমতার খেয়ালকে সসীমতার কাছে বোধগম্য করার জন্যই বোধহয় অংকের আবিষ্কার। অসীমতার নির্দেশিত খেলায়রত প্রণীকে যখন সে খেলার অপরাধে অংকের হিসাবে বিচার করা হয় তখন প্রকৃতির খেয়ালীপনার জন্য প্রাণীকেই নিষ্পেষিত হতে হয়।

পৃথিবীর প্রতিটি কাজের ব্যাখ্যা করা হয় অংকের নিয়মে।

খেয়ালী প্রকৃতির এ খেলা জমিদার দেখতে পারলে মানুষগুলোর চাকরী যাবে। আর মানুষগুলো তা দেখতে পারলে পাখীর হয়তো প্রাণ যাবে, আর বাসাটাও হয়তো ভেঙ্গে দেবে ওরা।

প্রকৃতির মহত্ব্যের বিশলতার কাছে মানুষের সীমাবদ্ধতা অংকের নিয়মে সরল সমাধান করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারে!

আজ এই মুহুর্তে ওর দেখা গল্পটার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

ওর বিরুদ্ধে যে এপ্লিকেশানটা এসেছে তার একটা বর্ণও মিথ্যা না বুঝতে পারলাম। ফিস জোগাড় না হওয়াই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার সৌভাগ্যই যার হয়নি পাশ করার সৌভাগ্যতো কল্পনাতীত।

ম্যাট্রিক পাশ করা ওয়ালাদের চাকরী এটা। কিন্তু তাতে গত বিশ বছর ধরেতো কোম্পানী বা অন্য কারো কোন ক্ষতি হয়নি। পক্ষান্তরে চাকরীটাকে দেবতার প্রসাদ ভেবে তাকে উদ্দেশ্য করে অমর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় কপাল ছুয়িয়েছে। দেয়া কাজ আর দায়িত্বকে বিধাতার আরাধনা ভেবে সমস্ত মন প্রাণ তাতে ঢেলে দিয়েছে।

মাটির গড়া দেবতাকে অবিনশ্বর ভেবে অমর ওর সব কিছুই তার পায়ে উৎসর্গ করেছে। কিন্তু আজ কোন এক সসীম সৃষ্টির একফোটা জলের ঝাপটায় যখন ওর মাটির দেবতা গলে পড়বে তখন রক্ত মাংসের ছাপোষা অমরের কি হবে!

কি বলবো আমি অমরকে!

Category: Bangla, Short Story

Comment List

Your email address will not be published.