দৈবক্রম -১৩

 

 

শাহেদ আর নাজমা সরকারের একটা ছেলে ছিল নাম মাহিম সারকার। এখানে এই লন্ডনেই জন্ম,   লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার বানিয়েছিলেন ছেলেকে। খুব ধুমধাম করে ছেলের দুবছরের জুনিয়র এক ডাক্তার মেয়ের সাথে বিয়েও দিয়েছিলেন ওরা।

বৌমা শাকিলা সেও বাঙালী কিন্তু মাহিমের মত এদেশই জন্মে এখানেই মানুষ হয়েছিল।

বিয়ের এক বছরের মাথায় ওদের কোল আলো করে ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান জন্ম নিল। ছেলে বউ দুজনেই সকালে কাজে বেরিয়ে গেলে ওকে নিয়েই থাকতো নাজমা। যে একটা বছর ছিল ছেলেটা তার অধিকাংশ সময়ই নাজমার কাছে কাটিয়েছে ও।

মাহিমের শশুর একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার তিনি তখন ইন্ডিয়ার ব্যাংগালোরে একটা সফটওয়ার ফার্মে কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকতেন তিনি। জন্মের পর নাতিকে দেখেনি ওরা। তায় ছেলেটাকে ওর বাবা মাকে দেখানোর জন্য অনেকদিন ধরেই বৌমা বলছিল মাহিমকে।

-সেবার দুজনেই লম্বা ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে ইণ্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। ব্যংগালোর ঘুরে ফেরার পথে ছেলেটাকে দেশে আমার ভাই আর ওর স্ত্রীকেও দেখিয়ে ফেরার কথা ছিল ওদের।

একটু থেমে একটা চাপা নিঃশ্বাস টেনে ধীরে ধীরে ছাড়লেন শাহেদ সরকার। একটা ঢোক গিলে কষ্টটা ঢাকার চেষ্টা করলেন।

-সব কিছুই ঠিকঠাক মতোই যাচ্ছিল। সেদিন বিকেল চারটের দিকে প্লেনটা নামার কথা ঢাকায়। আমার ভাই আর ওর স্ত্রী এয়ারপোর্ট থেকে ওদেরকে নেয়ার জন্য সময়মত এয়ারপোর্টে অপেক্ষাও করছিল।

-দেশে তখন প্রবল ঝড় আর বৃষ্টি। আবহাওয়া খুবই খারাপ। আমার ভাই এয়ারপোর্ট থেকে জানালো যে ঢাকার আবহাওয়া খারাপ হওয়াতে প্লেনগুলোকে অন্যান্য এয়ারপোর্টে রিডাইরেক্ট করা হচ্ছে।

-তারপর সংবাদ আসলো মাহিমদের বহনকারী প্লেনটা ইণ্ডিয়া থেকে দেশের আকাশ সীমায় প্রবেশ করার পর পরই দক্ষিণাঞ্চলের কোন এক পুরনো জমিদার বাড়ীর বাগানে ক্রাস করেছে।

প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন শাহেদ সরকার।

দুজনই নিস্তব্দ কিছুক্ষনের জন্য।   

সব কিছু হালকা করার জন্য শাহেদ সরকার হাসার চেষ্টা করলেন একটু।

-আমরা ছুটে গিয়েছিলাম ক্রাস সাইটে। সবই ভাগ্য! শুনেছি ক্রাস সাইট থেকে দুএকজন প্রাণে বেচে হেটে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্য খারাপ।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানলেন শাহেদ সরকার। 

-তখন থেকেই অনেকদিন নাজমা অসুস্থ ছিল। তারপর আমার ছোট ভায়ের পোতা জামিল আসার পর থেকে একটু সুস্থ স্বাভাবিক নাজমা। জামিলকে নিয়েই দিন কাটে ওর।

ব্যক্তিগত কথা বলে অতিথিকে বিব্রত করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন শাহেদ সরকার।

যার পর নেই সমবেদনা প্রকাশ করলেন নাসিমা মণ্ডল।

-বড় দাদু, বড় দাদিমা বলেছেন তার শরীরটা ভালো লাগছে না তায় নিচে আসবে না।

-আয় দাদু ভাই আয়, এই যে আমাদের দাদু ভাই যার কথা এইমাত্র আপনাকে বলছিলাম।

জামিলের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে স্বস্নেহে ওকে কাছে ডেকে বসালেন শাহেদ সরকার।

চমকে উঠলেন নাসিমা মণ্ডল জামিলকে দেখে। অবিকল আরিফের চেহারা!

সব কিছু গুলিয়ে যেতে লাগলো নাসিমা মণ্ডলের।

-জামিল গত দুবছর ধরে থাকে আমাদের সাথে। ওর বাবাকে অনেক বুঝিয়ে তারপর ওকে নিয়ে এসেছি আমরা।

জামিলকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগলেন শাহেদ সরকার। নির্বাক নাসিমা মণ্ডল।

-আমার ছোট ভাই শহিদ সরকার দেশে থাকে, ওর ছেলে আরিফ এর বাবা।

-আরিফের ছেলে! যেন আঁৎকে উঠে কথাটা বললেন নাসিমা মণ্ডল।

– হ্যাঁ, আমার ছোট ভায়ের ছেলে আরিফ। খুব ভাল ছেলে, আদর্শবান যাকে বলে, সিভিল সর্ভিসে চাকুরী পেয়েছে জয়েন করবে শিঘ্রি। জামিল ওর বাবার কার্বন কপি বলতে পারেন।

শাহেদ সরকার ওর একই শহরের বাসীন্দা আসার আগে সেটা জেনেই এসেছিল নাসিমা মণ্ডল। কিন্তু বিষয়টা এখানে আসার উদ্দেশ্যটা হাসিল করার শেষ অস্ত্র হিসেব ব্যবহার করার জন্য প্রসঙ্গটা গচ্ছিত রেখেছিল প্রাথমিক আলোচনা থেকে। কিন্তু এমনিতেই শাহেদ সরকার বিবাদটি মিটিয়ে ফেলার ভূমিকা নেয়ার জন্য  রাজী হওয়াতে যাওয়ার আগে প্রসঙ্গটা তুলে ওকে একটা প্লিজ্যান্ট সারপ্রাইজ দেবে বলে ভেবেছিল নাসিমা। 

-কিন্তু একি! আরিফের ছেলে, আরিফ বিবাহিত! কিছুই যেন মিলছে না। 

এটা কি করে সম্ভব! এতবড় প্রতারণা!

শাহেদ সরকারের দেয়া সব তথ্য, আর জামিলের চেহারার সাথে আরিফের হুবুহু মিল! এত কিছুতো মিথ্যা হতে পারে না!

ওদের বিয়ে হয়েছে গতকাল, আজ এতোক্ষণে শশুর বাড়ীর পথে অনন্যা। সবকিছু এক নিষ্ঠুর স্বপ্নের মত মনে হতে লাগলো নাসিমা মণ্ডলের কাছে।

-এরা কিছই জানে না আরিফের বিয়ের ব্যপারে। তায় অযথা জানিয়েও কোন লাভ হবে না। ভাবলেন নাসিমা মণ্ডল। 

কিছুই বললেন না তিনি শাহেদ সরকারকে। শুধু ওর পাশে বসা জামিলকে দেখলেন কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খঁটিয়ে।

কোনরকমে ভদ্রতার একটা আবরণ বজায় রেখেই সে রাতে বিদায় নিলেন নাসিমা মণ্ডল।

গাড়ীতে সারা রাস্তা নির্লিপ্তে ভাবলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন- নাহ, সব জেনে শুনে মেয়ের জীবনটা নষ্ট করার কোন অধিকার তার নেই।

বাসায় ফিরেই দেরী না করে টেলিফোন করলেন দেশে।

দেশে তখন সূর্য্যরে আলোর প্রথম রশ্মিটা উঁকি ঝঁকি মারছে কেবল। অনন্যা আর আরিফ ওদের হানিমুনের প্রথম রাতের সুখ স্বপ্নের সুখনিদ্রা ভাঙ্গার অনীহায় আড়ামোড়া ভাঙেনি তখনো।

টেলিফোন ধরলো কাজের মেয়েটা।

মেয়ের বিয়ের ব্যস্ততায় এ কদিন সকালে হাটাহাটি করার সুযোগ পায়নি সরোয়ার মণ্ডল।

ক্লান্তিতে শরীরটা ভরা থাকলেও মেয়ে জামাইকে হানিমুনের জন্য বিদায় দিয়ে মনের ফুর্তিতেই সাত সকালে উঠে একটু হাটাহাটি শেষ করে লনে ঈজি চেয়ারে গাটা এলিয়ে দিতেই কাজের মেয়েটা টেীলফোনের রিমোটটা দিয়ে জানালো লণ্ডন থেকে খালাম্মা। 

বেশ খোস মেজাজে টেলিফোনটা ধরলেন সরোয়ার মন্ডল।

অনন্যা আর আরিফের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে মেইন রাস্তায় একটা পুল ভেঙে আরিফদের বাড়ীতে যাওয়ার রাস্তাটা বন্দ হয়ে যাওয়াই নিকটেই সমুদ্র সৈকতে ওদের হানিমুনে যাওয়ার ব্যপারটা সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন সরোয়ার মণ্ডল। 

তারপর স্ত্রীর কাছ থেকে আরিফ সম্পর্কে যা কিছু শুনলেন তা বিশ্বাস করতে একদম ইচ্ছা হল না তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ানোর শক্তিই যেন হারিয়ে ফেললেন তিনি।

যথাশিঘ্র সম্ভব দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়ে নাসিমা মণ্ডল স্বামীকে বারংবার তাগাদা দিলেন যেন অনন্যা ফিরলে কোনক্রমেই ওকে আরিফের সাথে ওর শ্বশুর বাড়ীতে যেতে না দেয়া হয়। 

সে রাতেই বিস্তারিত সব রাজ্জাককে জানালে রাজ্জাকও দুঃখ প্রকাশ করে ওর শশুরের দেয়া অনন্যার বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হলে ভাল হত বলে মাকে জানালো।

কি যেন চিন্তা করলেন নাসিমা মণ্ডল। তারপর ছেলেকে বললেন- আমি কালই রওয়ানা হব, তুই বিয়াই সাহেবকে সব খুলে বলে আমরা অনন্যাকে ওখানে পাঠাবো না বলে জানাস। আর তোরা ব্যপারটা একদম গোপন রাখবি।

তিন দিনের দিন দেশে ফিরলেন নাসিমা মণ্ডল। ওই দিন দুপুর নাগাত হানিমুন থেকে ফিরলো ওরা।

অনন্যাকে ডেকে আলাদা ভাবে একান্তে সব খুলে বললেন নাসিমা মণ্ডল। ভাগ্যের উপর দোষ চাপিয়ে মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন।

-এ কি করে সম্ভব! এর কোন কিছুই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করলো না অনন্যার। ঘটনার আকস্মিকতাই অনন্যা হতবাক হয়ে একদম মুষড়ে পড়লো।

স্বপ্ন ভাঙতেওতো একটু সময়ের দরকার হয়। সুখ স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নই হোক তা ভেঙে গেলে বাস্তবে ফিরতে সবাই আড়ামোড়া ভাঙতে একটু সময় নেয়। কিন্তু একি হচ্ছে! আরিফ তো ওর কাছে এখন আর স্বপ্ন নয়। ওর ভালবাসা যে অনন্যার সমস্ত দেহ মনে স্থায়ী আসন গেড়েছে। ভাগ্যের দোহায় দিয়ে নিয়তি একি নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছে ওকে নিয়ে!

একদম পাথরের মত হয়ে রইলো অনন্যা। কাউকে কিছু বলতে বা জিজ্ঞেস করতে একটুও ইচ্ছে হলো না ওর।

নাসিমা মণ্ডল সব কিছু নিজ চোখে দেখে আসার অকাট্য প্রমান তুলে ধরে মেয়েকে অভয় দিয়ে বললো যে এ প্রতারনার দায়ভার ওদের বহন করতেই হবে।

আরিফের সাথে কাটানো চারটা দিনের প্রতিটি ঘটনা প্রতিটি মুহুর্ত চোখের সামনে এনে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো অনন্যা। ওর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি,  অভিবাক্তি,‌ কথা, আচরন সবকিছুই পর্যালোচনা করলো অনন্যা। কিন্তু আরিফের আন্তরিকতায় কোথাও একটুও ফাঁক ও খুজে পেল না।  

ভালভাবে না দেখেশুনে তাড়াহুড়ো করে মেয়ের জন্য এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নাসিমা মণ্ডল নানা ভাবে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলেন। অনন্যার এহেন পরিস্থিতিতে তিনি নিজেও ভেঙে পড়লেন। নাসিমা মণ্ডলের এমনিতেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তিনি একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

মায়ের এ অবস্থা দেখে অনন্যা নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে মায়ের মন থেকে অপরাধবোধ দূর করতে তৎপর হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে সচেষ্ট হতে লাগলো অনন্যা।

নাসিমা মণ্ডলও অনন্যাকে ওই চার দিনের স্মৃতিকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে যত দ্রুত সম্ভব তার সবটুকু স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে নানা ভাবে মেয়ের মনে জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন।

সবই বুঝলো অনন্যা। আরিফ ওর ভালবাসাকে চরমভাবে অপমান করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এত বড় অপমান ওকে যে করলো তার সাথে বসবাসতো দূরে থাক তার সাথে কোন কথা বলতেও মন থেকে সাঈ পেল না অনন্যা।

অনন্যা বারবার নিজেকে বোঝাতে লাগলো যে আরিফ বিবাহিত এবং একটা ছেলে সন্তান আছে ওর, যা ওর মা নিজে চোখে দেখে এসেছে। অন্য কেউ বললে হয়তো বা পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হতো।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.