দৈবক্রম -৭

[email protected]

 

 

চির অন্ধ সমাজ দৃশ্যতঃ কোন ব্যতিক্রম না দেখে নিজ গতিতেই এগিয়ে চললো। জামিলাও ওর কথা রাখলো। আরাফের স্মৃতিকে নিজ শরীর থেকে আলাদা করে বড়মাকে দেয়া ওর অঙ্গীকার পুরোপুরি পালন করলো। কিন্তু আরো একটা বড় সমস্যার হাত থেকে এই নিরপরাধ পরিবারটিকে বাচানোর জন্য কাউকে কিছু না বলে একদিন রাতের আধারে উধাও হয়ে গেল জামিলা।

প্রকৃতি সমাজ সকলে ধীরে ধীরে সব কিছুকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে চললো।

এভাবে চুপিসারে জামিলার নিরূদ্দেশ হওয়াটা হতবাক আরিফকে দারূনভাবে নাড়া দিল।

-জামিলারতো কোন দোষ নেই সে তার দুধের শিশুকে এভবে রেখে কেন পালালো?

অজানা একটা অপরাধ বোধ আরিফকে তাড়া করে ফিরতে লাগলো। কাউকে কিছু না বলে জামিলার একটা ছবি নিয়ে পুলিশ, হাসপাতাল সব জাইগায় খোজ করলো আরিফ। কিন্তু জামিলার কোন হদিছ মিললো না। ওর রেখে যাওয়া সন্তান, ভায়ের একমাত্র স্মৃতিকে বুকে তুলে নিল আরিফ। ওর মায়ের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখলো জামিল সরকার।

জামিলকে শুধু সামাজিক ছায়াই না পিতৃত্বের সবটুকু নির্যাস ঢেলে দিয়ে ওকে মানুষ করার সব দায়িত্ব গ্রহন করলো আরিফ।

সরকার পরিবারের আকাশে জমে ওঠা কালো মেঘ ভেদ করে আবার সুখ সুর্য্য উকি দিতে লাগলো।

বড় হতে লাগলো জামিল। আর ধীরে ধীরে চেহারাটা অবিকল আরাফ আর আরিফের মত হয়ে উঠতে লাগলো।

খুব মেধাবী ছাত্র জামিল। বাবার মত চঞ্চল। ওর বয়স যখন পাচ বছর তখন সালমা বেগম জামিলকে লণ্ডনে স্মামীর বড় ভাই শাহেদ সরকারেরর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

শাহেদ সরকার প্রায় বিশ বছর ধরে লণ্ডনে। যৌবনে একটা্ চাকরী নিয়ে ওদেশে যেয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। নাগরিকত্ব নিয়ে বাড়ী কিনে স্থায়ী ভাবেই বসবাস করছেন।

বড় ভাইকে বাবার মত শ্রদ্ধা করে শহিদ সরকার। ছোট বেলা বাবাকে হারিয়ে বলতে গেলে বড় ভায়ের কাছেই মানুষ হয়েছে।

নিজের পছন্দমত মামার মেয়েকে বিয়ে করেছে শাহেদ সরকার। বর্তমানে ওদের সাথে থাকার মত তখন কেউ নেই তায় স্ত্রীর পরামর্শেই জামিলকে লণ্ডনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি।

এদিকে পড়াশোনা শেষ করার পর সালমা বেগম ছেলেকে বিয়ে করার কথা বললে স্পষ্টভাবে না করে দেয় আরিফ।

-আমার উপর রাগ করে এমনিভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করবি বাবা।

-না মা তোমার উপর রাগ করার মত পাপ আমি কখনই করবো না। আমরা দুভাই যে তোমার চোখের দুটো মনি মাগো।

মায়ের চোখের পানি সযত্নে মুছে দেই আরিফ।

-তোমার কথা মানলাম মা, কিন্তু জামিলা যদি কখনো ফিরে আসে তখন কি জবাব দেবে তাকে। আবেগহীন জবাব আরিফের।

-বাস্তবতা ওইটুকু ছেলেকে এতকিছু শিখিয়েছে! ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন সালমা বেগম।

শহিদ সরকার প্রবেশ করলেন মা ছেলের কথার মাঝে।

জামিলা নিখোজ হওয়ার কয়েকদিন পর একদিন সন্ধার দিকে বাদশা মিয়া কাঁদতে কাঁদতে টেলিফোন করলো শহিদ সরকারকে। শহিদ সরকার ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলেন বাদশা মিয়ার বাড়ীতে।

বাড়ীটা অন্ধকার। ওর ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আর বউ নিরবে বসে।

সবার সামনেই হটাৎ করে বাদশা মিয়া মাটিতে পড়ে শহিদ সরকারেরর পা দুটো জড়িয়ে ধরে চাপা কণ্ঠে কাঁদতে লাগলো।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় শহিদ সরকার।

কিছু না বুঝেই ওকে শান্তনা দেয়ার জন্য বললেন -ঠিক আছে, কি হয়েছে আগে খুলে বলো বাদশা মিঞা।

সবই খুলে বললো বাদশা মিয়া, কোন কিছুই লুকালো না।

ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে শহিদ সরকারের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললো- কারো কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার শুধু আমার। আমি লোভী জানোয়ার। আমার লোভ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব শেষ করে দিয়েছে। আমার কোন ক্ষমা নেই, আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবে।

কান্নায় ভেঙে পড়লো বাদশা মিয়া। অনড় হয়ে দাড়িয়ে রইলেন শহিদ সরকার।

-ভাই আমার জামিলা পালিয়ে এখানে এসে ঘরে খিল দিল। কারো সাথে কোন কথা বললো না। আমার দিকে তাকাল একবার। শুধু ঘৃণা ঠিকরে বেরিয়ে আসলো।

-বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওর মা খাবার দিত, কিন্তু কিছুই খেত না মেয়েটা। পাথরের মত বোড়ায় হেলান দিয়ে বসে থাকতো।

-বেড়ার ওপাশ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে দু একটা কথা বলতো ওর মার সাথে। জামিলা ওর ছেলেটাকে দেখতে চেয়েছিল দুএক বার।

-আজ বিকেলে উকি দিয়ে দেখি মেয়েটা ঝুলছে কড়ি কাঠের সাথে, গলায় শাড়ি পেচানো। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখি সব শেষ। হতভাগী বোধহয় ছেলেটার মায়াই বেচে ছিল ওই কটা দিন।

কান্নায় ভেঙে পড়লো বাদশা মিয়া।

স্থবির হয়ে দণ্ডায়মান শহিদ সরকার যেন সম্বিত ফিরে পেলেন।

-কই জামিলা কোথাই?

ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। পাশের ঘরে শোয়ানো জামিলার নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে মনটা হাহাকার করে উঠলো শহিদ সরকারের। 

জামিলাকে প্রথম থেকেই স্নেহ করতেন তিনি। আর অতসব ঘটে যাওয়ার পর ওকে পুত্রবধুর নজরেই দেখতেন তিনি। ছেলেটা জন্ম নেয়ার কদিন আগে জামিলার মুখটা শুখনো দেখে আদর করে ওকে কাছে ডেকে বলেছিলেন- মা তুমি আমাদের আর বড়মা বড়বাবা বলে ডাকবে না, মা বাবা বলেই ডাকবে।

সেরাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাদশা মিয়াকে নিয়ে জামিলার লাসটা গোসল করিয়ে ওকে সরকার পারিবারিক গোরস্থানে আরাফের পাশে কবর দিলেন শহিদ সরকার।

এঘটনার বিন্দু– বিষর্গও তিনি সালমা বেগম বা আরিফকে জানতে দেননি। এ পরিবারের বার বার থেমে যাওয়া স্বাভাবিক জীবনের গতি যেন আর ব্যহত না হয় সেটায় ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

জামিলা সম্পর্কে এতসব সিদ্ধানে— স্বামীর নিরবতা সালমা বেগমকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলতো। কিন্তু এ পরিবারে জামিলার অধিকার এভাবে নিরবে সবার অলক্ষে প্রথিষ্ঠা করাতে স্ত্রী আর ছেলের চোখে শহিদ সরকার দেবতার আসনে আসীন হলেন।

অবশেষে বাবা মায়ের অনুরোধে ওদের পছন্দের পাত্রিকে বিয়ে করলো আরিফ।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.