ধারাবাহিক উপন্যাস # দৈবক্রম – ৬

দৈবক্রম – ৬

[email protected]

 

পরদিন খুব ভোরে সালমা বেগমের আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে দৌড়ে আসলো সবায়।

সালমা বেগম ভেবেছিলেন খুব ভোরে সবাই উঠার আগেই আরাফের সাথে বিষয়টা আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্ত একি হল! আরাফের নিঃস্তেজ দেহটা ঝুলে আছে সিলিং ফ্যানের সাথে। পার্থিব কোন সিদ্ধান্তই আর ওর জন্য প্রযোজ্য নয়।

একি করলো আরাফ! সব শেষ হয়ে গেল। হাসি খুশিতে ভরা সরকার পরিবারেরর বাতাস বোবা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো। নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা ওদের স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দিল।

দিন গড়িয়ে রাত আসলো, আকাশর মেঘ কেটে সূর্য্যও উঁকি দিল। কিন্তু কিছুতেই সরকার বাড়ীর বাতাস হালকা হল না।

আসল কথাটা কাউকে বললো না জামিলা। তবে ঘৃণায় ওর বাবা মায়ের সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করলো।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ পুরো সরকার পরিবার। এত বড় একটা শোক সংবরণের জন্য মন খুলে কেঁদে কেটে কেউ একটু হালকা হতে পারলো না। কিন্তু বাস্তবতার চাকা নিজ গতিতেই ঘুরতে লাগলো। জামিলার শরীরে আরাফের অঙ্কুর প্রাকৃতিক নিয়মে উত্থিত হয়ে ওর শরীর ভারী হতে লাগলো। সেদিকে নজর পড়ায় শোকে আভিভুত সালমা বেগম সম্বিত ফিরে পেলেন।

-বড়মা সব দোষ আমার। আমিই এর একটা ব্যবস্থা করবো। আপনাদের কারো কোন চিন্তা করতে হবে না।

জামিলার কথাটা কানে বেজে উঠতেই আৎকে উঠলেন সালমা বেগম।

আসলে ব্যবস্থটা জামিলা নিজেই গ্রহন করতো। কিন্তু আরাফ সে সুযোগ ওকে দিল না। প্রকৃত অর্থে ভালবাসা যে কি জামিলা তা জানে না। নিজ গর্ভে লালীত আরাফের সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ জন্মানোর ফুসরত ওর ভাগ্যে জোটেনি। শুধুমাত্র বড়মার প্রতি ভালবাসা আর সরকার পরিবারের প্রতি ওর কৃতজ্ঞতাবোধ ওকে চুড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থ করল।

আরাফের মৃত্যুর পর পরই আরো একটা আঘাত সরকার পরিবারের সোজা হয়ে দাড়ানোর শেষ সাহস টুকুর মুলোৎপাটন করবে তা জামিলা অনুধাবন করতে পেরেছিল।

আরাফের আত্মহত্যার কারণটা ওরা বাদে বাইরের কেউ জানত না।

পুত্র শোকে আত্মবিসৃত জামিলা বেগম যেন হুস ফিরে পেলেন। একটু দেরীর জন্য অত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল, আর দেরী হলে যে আরো বড় ক্ষতি হবে। জামিলার দেহে যে আরাফের স্মৃতি জীবিত এখনো!

দ্রুত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলেন তিনি। নিজে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে পরিপাটি হলেন।

জামিলাকে স্বস্নেহে ডেকে চা দিতে বললেন।

-কি করে রেখেচিস নিজেকে হতভাগী। আমি চা খেতে খেতে যা গোসল করে আয়।

জামিলার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিতে নিতে বললেন জামিলা বেগম।

বড়মার এ পরিবর্তনে অবাক হলেও ভাল লাগলো জামিলার।

গোসল সেরে বাইরে আসতেই দেখে বড়মা দাড়িয়ে বাথরুমের সামনে।

চমকে উঠলো জামিলা।

সালমা বেগম তার বিয়ের সময়কার শাড়ী ব্লাউজ পেটিকোট বের করে সাজিয়ে রেখেছে খাটের উপর।

-যা ওগুলো পর মা।

জামিলার চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

-আমাকে এত বড় শাস্তি দেবেন না বড়মা। আমি কথা দিচ্ছি আমার শাস্তি আইি নেব।

জামিলা ডুকরে কেদে উঠে সালমা বেগমের পায়ের উপর পড়লো।

সালমা বেগম নিজের চোখ দুটো মুছে নিয়ে জামিলাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

-নারে হতভাগী না, আরাফ আমাকে সময় দিল না, আমিতো এটাই ঠিক করেছিলাম মনে মনে।

একটু থেমে নিজেকে প্রকিতিস্থ করলেন সালমা বেগম। জামিলাকে নিজের পাশে খাটের উপর বসালেন।

-শোন, যা হারিয়েছি তাতো আর ফিরে পাওয়ার নয়। সন্তান হারানোর ব্যথা না হারালে বোঝা যায় না। আমার আরাফ বেচে আছে তোর শরীরে, ওটাকে হারাতে চায় না আর।

-তুমি কথা দাও মা যে কোন ত্যগের বিনিময়ে আমার আরাফের স্মৃতিটাকে স্বযত্নে আগলে রেখে আমাকে উপহার দেবে।

কাঁদতে লাগলেন সালমা বেগম। কোন কথায় যেন বের হচ্ছে না জামিলার কন্ঠ দিয়ে।

-না চুপ করে থাকলে চলবে না, কথা তোমাকে দিতেই হবে।

মরিয়া হয়ে উঠলেন সালমা বেগম।

-কথা দিলাম বড়মা।

মনে হল একটা পাথরের মুর্তির দেহ থেকে বেরিয়ে আসলো কথাটা।

নতুন করে স্বপ্ন দেখা সালমা বেগম তা খেয়াল করলেন না মোটেও।

জামিলার দেহে আরাফের স্মৃতি দিনে দিনে আরো পরিস্কার হয়ে ফুটে উঠতে লাগলো। এমতাবস্থায় সালমা বেগমের সব উপদেশ বিনা প্রশ্নে পালন করতে লাগলো জামিলা।

কিন্তু এক নতুন বাস্তবতা সালমা বেগমের সামনে হাজির হয়ে সব পথ রোধ করে দাড়ালো। ওর সব স্বপ্ন আবার নতুন করে ভেঙে চুরমার হওয়ার উপক্রম হলো।

-আগত সন্তানের সামাজিক পরিচয়!

বন্ধুর মত ভাইকে ওভাবে হারিয়ে বাকরূদ্ধ স্বল্পভাষী আরিফ। আরাফের আত্মহত্যার কারণ এবং পরবর্তিতে এতসব ঘটনার বিন্দু– বিষর্গও জানে না আরিফ।

সেদিন গভীর রাতে শোকাগ্রস্ত বাবার উপস্থিতিতে মায়ের মুখ থেকে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আরিফ।

তারপর আরিফর সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে ও দুপায়ের সবটুকু জোর হারিয়ে থপ করে বসে পড়লো যখন ওর মা কাঁদতে কাঁদতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো –বাবা আরাফের শেষ চিহ্নের শুধু একটা সামাজিক পরিচয়ের জন্য জামিলাকে বিয়ে করতে হবে তোকে। তারপর বাচ্চাটার জন্ম হলেই আমরা তালাকের ব্যবস্থা করবো।

ক্রন্ধনরতা মা আর পাশে মূক হতবাক উপবিষ্ঠ বাবা। এদের অসহায়ত্বের গভীরতা আঁচ করতে মোটেও কষ্ট হলো না আরিফের।

-বাবা ওই আগত সন্তানের মধ্যেই আমরা খুজে পাব আরাফকে। আর সমাজের অপবাদ থেকেও বাচবো আমরা। আরাফ পাপ করেছে, ওতো অবুঝ, আমাদের সন্তা্‌ তোর ভাই। হতভাগা শেষে জীবনটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে গেল!

কান্নায় ভেঙে পড়লেন সালমা বেগম। পাথরের মত উপবিষ্ঠ বাবা। পাথরের মত দাড়িয়ে দরজার আড়ালে জামিলা।

সামাজিক প্রয়োজনটা সবকিছুর উর্দ্ধে। এর কোন আবেগ নেই এর অনুশাসন সবাইকে মানতে হবে সমাজে বাস করতে হলে।

প্রকৃতি নিজস্ব মাপকাঠিতেই চলে। ঠিক সময়মত একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তানের জন্ম দিল জামিলা।

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.