দৈবক্রম # ৪
ছ মাসের মাথায় অনন্যা মেয়েকে রেখে লণ্ডন চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই নাতনীকে নিজের কাছে আনলেন সালমা বেগম।
আরিফ ছুটি নিয়ে বাড়ী এলো। পুতুলের মত তুলতুলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকলো। অভূতপূর্ব স্বর্গীয় এক তৃপ্তিতে ওর সারা দেহ মন আন্দলিত হলো।
এ যেন নিজেকে অনুভব করা! আরিফ প্রাণ খুলে কথা বলতে লাগলো অতটুকু মেয়ের সাথে।
আরিফের ক’মাসের মেয়ে যেন কোন এক যাদুর ছোয়াই পরিবারের সবাইকে প্রাণের জোয়ারে উদ্বেলিত করলো।
-কি নাম রাখা যায় বলতো মা।
-ওরা এর নাম দিয়েছে- ভাবনা।
নাতনীকে আদর করতে করতে ছেলের কথার জবাব দিলেন সালমা বেগম।
-ভাবনা!
অবাক হলো আরিফ। নামটা খুব চেনা আর পছন্দের ওর।
মনে পড়লো আরিফ অনন্যাকে বলেছিল যে ও চায় ওদের প্রথম সন্তন যেন মেয়ে হয়। আরিফের মায়েরও মেয়ে খুব পছন্দ। ওদের দু’ভায়ের সংসারে কোন মেয়ে নেই। তায় মা সবসময় চায়তো ওদের দু’ভায়ের যেন কেবলই মেয়ে সন্তান হয়।
-মেয়ে হলে তার নাম রাখবো ভাবনা। ও আমাদের সমস্ত ভাবনা জুড়ে থাকবে সারাক্ষণ।
আরিফ শুধু অনন্যাকেই বলেছিল কথাটা। অন্য কারো তা জানার কথা না।
-কিন্তু তাকি অনন্যার মনে থাকার কথা!
-তাহলে?
সবকিছু এলোমেলো লাগলো আরিফের।
-হ্যাঁ, এ নামেই আমি ডাকবো ওকে।
মায়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেল আরিফ।
ভাবনাকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরূ করলো আরিফ। জীবনের ছিড়ে যাওয়া তারগুলো আবার নতুন করে জোড়া দিতে চায়লো।
মায়ের সাথে আলোচনা করে ঠিক করলো ভাবনাকে রাখবে নিজের সাথে। মাতো আছেই তাছাড়া আরিফের দূরসর্ম্পকীয় বিধবা খালা রাহেলা বেগমকে নিয়ে রাখবে ভাবনাকে দেখাশোনা করার জন্য।
এভাবেই বাবার মেয়ে হয়ে বড় হতে থাকে ভাবনা। আর সন্তর্পণে এক একটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা ওর সামনে আসতে শুরূ করলো।
সে সব কথা ভেবে আগে ভাগেই সে নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জীবন চলার জন্য আরিফ ধীরে ধীরে ভাবনাকে প্রস্তুত করতে থাকল।
মায়ের প্রশ্নে ভাবনাকে একটা ভ্রান্ত ধারণা দিতে চায়লো আরিফ। যাতে মায়ের প্রতি কোন বিতৃষ্ণা যেন না জন্মায় ওর কচি মনে।
খুব ধীরে ধীরে আরিফ ভাবনার মনে ওর নিজের সম্পর্কে একটা ছবি আকতে চায়লো। ভাবনাকে বুঝালো যে বাবার সে ছবিটা ও যেন অন্য সবার কাছ থেকে গোপন রাখে।
মেয়েকে বুঝালো যে যৌবনে সে নিজে বিভিন্ন কারণে বিপথগামী হয়ে পড়েছিল। যার জন্য আজও তার অনুশোচনা হয়। অনেক বড় একটা পাপ করেছিল ও, যা ইচ্ছে করেই সবার কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল।
ওর মা অনন্যা, সুন্দরী সুশীলা মহিলা, অনেক বড় ঘরের মেয়ে। আরিফের সাথে বিয়ে না হলে নিশ্চয় অন্য কোন ভাল জাইগায় বিয়ে হতো তার। আর বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই এভাবে স্বামীকে ছাড়তে হতো না।
-বড় ভালো মেয়ে ছিল তোমার মা, কিন্তু কেন যে আমার মত একটা বাজে মানুষের সাথে বিয়ে হলো তার!
মেয়েকে এসব কথা বলতে বলতে চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠতো আরিফের। গলাটা ধরে আসতো ওর।
-কিন্তু মা, তোকে পেয়ে আমি একদম ভালো হয়ে গেছি। আগের সবকিছুই ভুলে গিয়েছি আমি।
কথাগুলো বলতে বলতে ভাবনাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতো আর কাঁদতে কাঁদতে বলতো -তোর মার মত রাগ করে আমাকে ফেলে কোন দিন যেন চলে যাসনে, তুই গেলে আমার যে আর কেউ থাকবে না মাগো।
কাঁদতে কাঁদতে চুমুই চুমুই ভরে দিত মেয়ের তুলতুলে দুটো গাল। অবুঝ শিশু ভাবনা ওর নরম কোমল হাত দুটো দিয়ে বাবার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দিত।
ছোট্ট মেয়ের এহেন ব্যবহারে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তো আরিফ। ভাবনার তুলতুলে হাতদুটো বিধাতার পরশ বলে মনে হতো। আর তাতে ওর সব বেদনা লাঘব হয়ে যেত।
এ গল্পটা ভাবনাকে অনেকবার বলেছে আরিফ। তায়তো কাল্পনিক ঘটনাটা দিনে দিনে ওর নিজের কাছেও সত্য ঘটনার মত জ্বলজ্বল করে ওঠে এখন।
ভাবনা একটু বড় হলে মা কোথায় থাকে তিনি কেমন আছে ইত্যাদি বাবাকে জিজ্ঞেস করতো। কারণ ততোদিনে মায়ের প্রতি ভাবনার মনে একটা মমত্ত্ববোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল আরিফ।
-তোমার মা লণ্ডনে আছে এতটুকু জানি। এর বেশি আমার জানা নেই মা।
ভাবনা বড় হয়ে নানা নানিদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেও ফল হয়নি কোন। কারণ ওবাড়ীর সবাই ততোদিনে লণ্ডনে সেটেল্ড হয়ে গিয়েছিল।
-কি জানি কেমন আছে মা!
আফসোচ করে বলতো ভাবনা।
-আমি বড় হলে মাকে খঁজে বের করে বলবো -মা আমার বাবা খারাপ না, দুনিয়ার সব বাবার থেকে ভাল।
কথাগুলো বলতে বলতে ভাবনা বাবার বুকে মুখ লুকাতো। মেয়েকে আদর করতে করতে আরিফের চোখদুটোও অশ্রুসজল হয়ে উঠতো।
-তুমিওতো ভাল নেই বাবা মাকে ছাড়া। ঈস, মা যদি একটু ধৌর্য্য ধরতো তাহলে ঠিকই বুঝতো তুমি এখন আর একদম খারাপ নও।
মেয়েকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য আরিফ পড়াশোনার বাইরে ভাবনাকে নাচ গান খেলাধুলা ইত্যাদিতে উৎসাহ যোগাত। তাতে ভাবনাও নিজেকে নিয়ে নানাভাবে ব্যস্ত থাকতো।
ভাবনা সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করলো। সেদিন আরিফের মনে হলো আকাশ থেকে সব ফেরেস্তারা দলে দলে নেমে এসে আনন্দমেলা বসিয়েছে ওর বাড়ীতে।
সে রাতে ক্লান্ত হয়ে ভাবনা ঘুমিয়ে পড়লে আরিফ ওর বৃদ্ধ বাবা মা আর রাহেলা খালাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মত কাদলো।
আরিফের মত একটা অবারিত সম্ভাবনায় ভরা জীবনটার এরকম দশার জন্য ওর বাবা মা নিজেদেরকে ভীষণ অপরাধী মনে করে আর সেজন্য গভীর একটা অপরাধবোধ সারাক্ষন তাড়া করে ওদেরকে।
আরিফের বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কয়েক মাস পর ওরা জানলো প্রায় দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে ওদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে যে কাজটি আরিফকে করতে হয়েছিল তার খেসারত আরিফকে সারা জীবন ধরে দিতে হচ্ছে।
I had a long career in Army. I was trained to follow orders, instructions and set rules, taking those as axiomatic. That strayed me a bit from free thinking as happens with all technology users. Basically I am a free thinker always and now in search of some basic truth in my own way. ([email protected]).