বাংলা ছোট গল্প- বৃদ্ধ হওয়া

বৃদ্ধ হওয়া

 

[email protected]

আমার আঠারো বছরের ছেলেটাকে যেদিন উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে বিদায় জানালাম সেদিনই আমি বৃদ্ধ হয়ে গেলাম ।

আমার ছেলেকে নিয়ে প্লেনটা আকাশে উড়তেই আমি ধপ করে পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম । আর বসে বসেই কাঁচের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে যতোক্ষন দেখা যায় প্লেনটার দিকে তাকিয়ে   দেখলাম ।

উঠে দাড়ানোর জোরটুকু যেন হারিয়ে ফেললাম এই মুহুর্তে । জীবনটা যেন দাড়িয়ে গেল ।

 

ও আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। ওকে আমরা আকাশ বলে ডাকি । প্রথম মেয়েটার দশ বছর পর ওর জন্ম । আমার সাথে বয়সের পার্থক্য চল্লিশ বছরের ঊর্ধ্বে । আমি যখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কিছুটা অন্যমুখি হওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন একটা সময় আকাশের জন্ম । ওর যখন জন্ম হলো সত্যি বলতে বাচ্চা জন্ম নেয়া আর পালনের সব অভিজ্ঞতায় বিস্তৃতপ্রায় আমরা । ও আসার প্রস্তুতি হিসাবে

সব কিছুই আবার নতুন করে জানতে হলো শিখতে হলো ।

চাকরীতে বেশ একটু সিনিয়র হওয়ার সুবাদে আকাশের জন্ম হওয়ার কিছু আগ থেকে সরকারি আলাদা বাংলোতে আমারা বসবাস করি । সরকারি চাকরীর এটাই নিয়ম । বাংলোগুলো সাধারণত অন্যান্য বাসা বা ফ্ল্যাট থেকে একটু দুরে হয় । তার জন্য অবশ্য আমাদের বা বড় মেয়েটার বিশেষ কোন অসুবিধা হয়নি । কিন্তু অসুবিধা হলো আকাশের জন্য কারণ যেহেতু অন্য বাসাগুলো দূরে দূরে তায় ধারের কাছে ওর খেলার সাথি পাওয়া যায় না ।

ধারের কাছে বন্ধু বান্ধব না থাকাটা আকাশের আজন্ম অভিযোগ । ওর ফ্ল্যাটের বন্ধু বান্ধবদের উদাহরণ দিয়ে আমাদের বাসা ফ্ল্যাটে নয় কেন, ফ্ল্যাটে বাসা হলে ওর খুব ভালো হতো ইত্যাদি বলে ও সব সময় মন খারাপ করে। ফ্ল্যাটে বাসা না নেয়ার জন্য ও সর্বদায় আমাকে দোষারোপ করে ।

স্কুলের পর বাসায় ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। ওর বড় বোন যে ওর থেকে দশ বছরের বড় সে ব্যস্ত নিজের পড়াশোনায় । আর বয়সের পার্থক্যের দরুন ওদের সম্পর্কটা কিছুটা  আনুষ্ঠানিক । আমার স্ত্রীও সেভাবে আকাশকে সময় দিতে পারে না । আর আকাশ ওর খেলার সাথি হিসাবে মাকে ঠিক পছন্দও করে না । অতএব ওর খেলাধুলা, পড়াশোনা, গোসল খাওয়া ঘুমানো যাবতীয় সব কিছুই আমাকে নিয়েই।

আমি ওর মন থেকে একাকিত্বের অভাব দূর করার জন্য বাসায় নানারকম খেলার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করলাম । আর সাথি হিসাবে ধীরে ধীরে আমাকেই বেছে নিল আকাশ । ঘরের ভিতর স্ক্রাবেল বা দাবাখেলা বা বিল্ডিং ব্লক দিয়ে কল্পনার সবকিছু বানানো থেকে শুরু করে বিকালে লনে ছুটোছুটি আর লেনে ফুটবল খেলাতে আমিই ওর সাথি ।

কোন সময় একটু ব্যস্ততার জন্য বা ক্লান্ত হয়ে যদি খেলাটা বন্ধ করার কথা বলি তবে ও অভিমানে ফেটে পড়ে । বিরক্ত হয়ে যদি কখনো একটু আধটু বকা দিয়ে মুখটা একটু গোমরা করি তবে ও জল টলোমলো চোখে আমাকে ভয় দেখিয়ে বলবে তোমার সাথে আমি জীবনেও কথা বলবো না । আমি রাগ করে জংগলে চলে যাবো আর শিয়াল বাঘ এসে আমাকে খেয়ে যাবে । আমি আর আসবো না ।

আকাশের এ ধরনের কথাবার্তা নিতান্তই ছেলেমি হলেও কথাগুলো আমাকে দুর্বল করে দিত । তারপর স্বভাবতই ওকে আদরের পরিমানটাও বাড়িয়ে দিতাম অনেক গুনে।

বাড়ীতে আকাশ একদম একা। ওর এই একাকিত্ব আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয় । তায় ওর সাথে তাল মিলাতে যেয়ে আর বৃদ্ধ হতে পারলাম না।

হাটি হাটি পা পা করে ও যতই বড় হতে লাগলো একটা মেয়ে সন্তান আর একজন ছেলে সন্তান পালনের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে শুরু করলাম।    

ওর বয়স তখন কত ঠিক মনে নেই, হাটাহাটি দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। আমি একদিন একটু অন্যমনষ্ক হয়ে বারান্দায় পায়চারী করছি, হাতদুটো পিছনে ভাজ করা । একটু অন্য মনষ্ক অবস্থায় পায়চারী করলে ও রকম ভাবে হাটাই আমার অভ্যাস । কিন্তু নিজের এ অভ্যাসটা আমার চোখে ধরা পড়লো সেদিনই মাত্র । যেদিন হঠাৎ করেই নজরে পড়লো আকাশ বারান্দার অন্য পাশে ঠিক অমনি ভাবে পিছনে হাত বেধে আমার মত করে হাটার চেষ্টা করছে । আকাশ আমার সব কিছুই অনুকরন করে । আমি যে ভাবে ওর মায়ের সাথে, বোনের সাথে, কাজের ছেলেটার সাথে কথা বলি আকাশ অবিকল তেমনি ভাবে কথা বলার চেষ্টা করে ।

আকাশকে দেখেই প্রকৃত পক্ষে আমি আমার নিজের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারি । ওর প্রতিটি চলাফেরা কথাবার্তা সব কিছুর মধ্যে আমি আমাকেই দেখি ।

আমার ধৈর্য চিরকালই একটু কম । কথাটা আমার স্ত্রী সহ অনেকেই আমাকে বলেছে । আমি কখনোই গুরুত্ব দিয়নি বিষয়টাকে । কিন্তু যেদিন আকাশকে আমার অনুকরনে খেলার সময় কাজের ছেলেটাকে বলতে শুনলাম তুই বেশী বুঝিছ, একটা থাপ্পর দেবো । তখনই প্রকৃত অর্থেই বুঝলাম ধৈর্য হারালে আমাকে কত কদার্য লাগে । প্রকৃতপক্ষে আকাশকে লক্ষ করেই অকারণে আমার ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার আজন্ম বদঅভ্যাসটা সেদিনই ত্যাগ করলাম ।

এভাবে ওর মধ্যেই আমি এক নতুন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ।

আমি যে রকম জামা কাপড় বা স্যুট তৈরী করবো ওকেও একই রকম জিনিস তৈরী করে দিতে হবে । বাথরুমে আমার সেভিং ইত্যাদি সরঞ্জামের মত ওর গুলোও সাজিয়ে রাখতে হবে ।

আকাশের স্কুলটা আমার অফিসের সামনে রাস্তার এপার ওপার । ওর স্কুল আর আমার অফিস শুরু হওয়ার সময়টাও এক তায় ওকে সকালে আমিই নামিয়ে দিই । ওর স্কুল আমার অফিস ছুটির প্রায় ঘণ্টা দুই আগে শেষ হয় । ড্রাইভার ওকে আমার অফিসে নিয়ে আসে । বাকি সময়টুকু আমার অফিসে ঘোরাঘুরি করে আমার সাথেই বাসায় ফেরে আকাশ ।

অফিস থেকে ফেরার পর ওকে সঙ্গ দেয়াই আমার প্রধান কাজ । বিকেলে বাইরে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেয়া, বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যে সমস্ত সামাজিক মেলামেশার অভ্যাস ছিল তা সব ধীরে ধীরে প্রায় ছেড়েই দিলাম।

স্কুল থেকে ফেরার পর সারাক্ষন ও আর আমি ।

এমনি ভাবেই আকাশের বেড়ে ওঠা । আমি আর ও মিলে ছোট্ট একটা পৃথিবী গড়ে তুললাম দিনে দিনে ।

আকাশ সবার ছোট হওয়াতে আমরা সহ ওর বোনও ওকে অত্যাধিক আদর করে । মাঝে মাঝে ওর বোন খেলার ছলে ওকে জিজ্ঞেস করে যে পরিবারের সদস্যদের কার স্থান ওর শরীরের কোনখানে । জবাবে আকাশ সব সময়ই হাত দিয়ে ওর শরীরের বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করে দেখায় ।

যেমন ওর আপুর স্থান কোন সময় ওর হাটুতে বা একটু উপরে উঠে পেটের কাছে থাকে । কাজের ছেলেটার স্থান মোটামুটি সবসময়ই নিচে একদম পায়ের কাছে। কারণ ও সব সময় মা বাবা আর আপুর কথা বেশী শোনে এই জন্যই ওর উপর যত রাগ । মায়ের জায়গাটাও উঠা নামা করে। কিন্তু বাবার জায়গাটার কথা জিজ্ঞেস করলে আকাশ মিটি মিটি হেসে সবসময়ই বুকের মাঝখানটা দেখাবে । এর কোন হের ফের কখনো হয়না ।

একটু বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আকাশ আমার সাথেই রাতে ঘুমাই । ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমার বুকের সাথে ওর বুকটা লেপটে রাখে । রাতে ঘুম ভাঙলে হয় ওর হাত আমার গায়ের উপর তুলে দেয় বা আমার হাতটা টেনে ওর গায়ে নেয় ।

ক্লাস নাইনে উঠার পর থেকে ও আর আমার সাথে ঘুমায় না । ও যে পছন্দ করে না তা নয় । রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয় তায় ।

আকাশ একটু বড় হলে ওর প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওকে কখনো নিজে সাথে করে নিয়ে যেয়ে আবার কখনো বা কাজের ছেলেটাকে দিয়ে পাঠিয়ে পার্কে বন্ধু বান্ধবদের সাথে বিকালে খেলাধুলা করতে যাওয়ার অভ্যাসটা গড়ে তুললাম । কিন্তু বন্ধুদের সাথে যতই খেলাধুলা করুকনা কেন ফেরার পর সন্ধ্যা বেলা আমাদের বাসার লেনে আমার সাথে দুএকবার দৌড় প্রতিযোগীতা না করলে ওর দিনই যেন শেষ হয় না।

লেনটা বেশ বড়। আমাদের দৌড় শুরুর স্থান থেকে শেষ অব্দি ছুয়ে ফেরত আসলে কম করে হলেও পঁঞ্চাশ গজ হবে। ক্লাস সিক্স সেভেন পর্যন্ত আকাশ আমার সাথে দৌড়ে পারতো না । প্রায়শঃই ওকে আমি ইচ্ছা করেই জিতিয়ে দিতাম যাতে ও মজা পায় ।

কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারতাম আমি আসলেই ওর সাথে দৌড়ে আর পারছি না । প্রথম প্রথম নিজেরই বিশ্বাস হতো না যে আকাশ আমাকে দৌড়ে হারিয়ে দিচ্ছে ।

কিন্তু সত্যি সত্যি যেদিন দেখলাম যে আকাশ আমার হাতের আঙ্গুল ধরে ধরে ওর জীবনের প্রথম পাটা বাড়ালো সেই আকাশ অনায়াসে দৌড়ে আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় । তৃপ্তিতে আমার মনটা  ‍জুড়িয়ে গেল । আহ এ পরাজয়ে যে কি আনন্দ কি সুখ তা কেবল তারাই জানে যারা সামনে যাওয়ার প্রতিযোগীতায় প্রতিদিন নিজের কাছে নিজে হারতে থাকে।

 

আজকাল আমি হাফিয়ে যায় ওর সাথে দৌড় প্রতিযোগীতায় । তবুও দৌড়ায়, হেরে যাওয়ার আনন্দে দৌড়ায় ওর সাথে।

আজকাল দৌড় শেষ করে আমি বসে পড়ি, জিব বের করে হাফায় । আমার অবস্থা দেখে আকাশ হাসে। ভাবে আমি বোধহয় মজা করছি। ও মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে আমি কেন এমন করছি।

আমি বলি বাবা আমার বয়স বাড়ছে না।

হাসতে হাসতে আকাশ জবাব দেয় বয়সতো ওরও বাড়ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি হো হো করে হাসি। আকাশও যোগ দেয় হাসিতে। তারপর দুজন গলা ফাটিয়ে হাসি।

হাফাতে হাফাতে হাসতে হাসতে মাঝে মধ্যেই আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আকাশ ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আকাশ তখন ক্লাস এইটে। প্রতিদিনকার মত সেদিনও বিকেলে হাটাহাটি করে লেনে বসে আছি আকাশের জন্য । ও খেলা শেষ করে আসলে দুজনে দৌড়টা দিয়েই দিনটা শেষ করবো । সন্ধ্যে গড়িয়ে যাচ্ছে তবু আকাশ আসছে না। অস্বস্তি লাগতে লাগলো। এ যে রুটিনের অনাকাক্ষিত ব্যতিক্রম।

আমি লেনে চেয়ারে বসে ভাবছি কি হলো আকাশের। কিছুক্ষন পর কাজের ছেলেটা টেলিফোনের রিমোটটা দিয়ে বললো আমার ফোন ।

আকাশের গলা।

—বাবা আজ থেকে আমাদের রেস বন্ধ। হাসতে হাসতে কথাটা বললো ও।

—কারণ তুমি হাফিয়ে ওঠো আজকাল । ফুটবল খেলার পর আমার বন্ধুদের সাথে ক্লাবে টেবিল টেনিস খেলে একেবারে ফিরবো । 

ব্যস্ততার মধ্যে আমাকে বাই বলেই রেখে দিল।

বুঝলাম আমার আকাশ বড় হচ্ছে। একটু একটু করে ওর নিজস্ব একটা আলাদা জগত গড়ে উঠছে।

যেদিন থেকে বিকেলে আমাদের রেস দেয়া বন্দ হলো সেদিনই বুঝলাম রেসে আমি আর ওর সমকক্ষ নয়। আকাশ আমাকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গিয়েছে।

মনকে বুঝালাম —এইতো আমি চায়, প্রতিটি বাবা মা’তো তায় চায়। সন্তানেরা তাদেরকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে চলে যাক! 

 

আজ আমার আকাশ সকলকে ছাড়িয়ে ওর স্বপ্নের জগতে পাড়ি দিয়েছে। সেখানে কত লেখাপড়া কত ব্যস্ততা থাকবে ওর। পড়াশোনা আর অন্যান্য ব্যস্ততা ওকে ধীরে ধীরে আষ্টে পিষ্টে বেধে ফেলবে। আমার কথা মনে করার ফুসরতও অনেক কমে যাবে। এটাই তো জীবন। এগিয়ে যাওয়ার জন্য অতীতকে পিছনে ফেলতেই হবে।  

এভাবে কতক্ষন বসে ছিলাম জানিনা। আমার স্ত্রীর ডাকে স্বম্মিত ফিরে পেলাম।

ছেলেকে বিদায় দিয়ে অন্যান্য কিছু চেনা মানুষের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে আমার স্ত্রী আমাকে ডাক দিয়ে বাড়ী ফেরার তাড়া দিল।

উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো।

শরীর খারাপ করছে কথাটা বলা আমার একদম অপছন্দ। বাবার শরীর খারাপ এটা আকাশের অভিধানেও বোধহয় ছিল না। কিন্তু এখন আমার স্ত্রী আমার শরীর খারাপ লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করলে নির্দিধায় হ্যাঁ বলে জবাব দিলাম।

এ অবস্থায় আমার গাড়ী চালানো ঠিক হবে না বুঝে আমার স্ত্রী টেলিফোন করে বাসা থেকে ড্রাইভারকে আসতে বললো ।

আমি বসে আছি কর্মব্যস্ততায় ভরা সব মানুষের মধ্যে। কিন্তু আজ আর আমার কোন ব্যস্ততা নেই। প্রয়োজনও নেই কারো আমাকে। আমার যা কিছু করার সব করেছি যা কিছু দেয়ার তার সবই দিয়েছি। কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে এতকিছু যে নিয়েছি ওর কাছ থেকে তাতো ও থাকতে একটুও বুঝিনি।

এ বোঝা যে অনেক ভারী। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ ভার আমি বইবো কেমনে।

আকাশকে ঘিরেই যে আমার সব কিছুই আবর্তিত হতো । আজ আকাশ আর নেই। এখন থেকে ও ওর নিজের গড়া পৃথিবীতে বিচরন করবে। খেলার সাথির জন্য আমাকে আর দরকার হবে না ওর।

গত আঠারো বছর ধরে সব ছেড়ে ওকে নিয়ে আমি আমার যে ছোট্ট পৃথিবী গড়েছিলাম সেখানে ও ছাড়া আমার আর কেউ ছিল না। 

সে পৃথিবীতে এখন আমি যে একদম একা। আমার দিন চলবে কাকে নিয়ে।

আকাশ চলে যাবে এতো নতুন কোন কথা নয়। সবার আকাশই তো চলে যায়। নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম।

কিন্তু অন্য কারো আকাশ গেছে কি আছে তা শুনে আমার কি হবে। সেত বিধাতার হিসেবের বিষয়। আকাশ বাদে আমার চলবে কি করে!

চারিদিকে এত আলো তবু মনে হলো অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরছে। এত বাতাস তবুও আমার দম বন্দ হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

ড্রাইভার আসলো । রওয়ানা হলাম আমরা।

 

—বাবা আমার কি হবে, আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন!

আমার সাথে ধাক্কা লেগে আমার আকাশের গা থেকে রক্ত ঝরছে। ওর যন্ত্রনা করছে, আমার কাছে জানতে চাচ্ছে ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন।

একদিন বিকালে খেলতে খেলতে আমার সাথে ধাক্কা লেগে আকাশ পড়ে গেল। একটা ভাঙ্গা বোতলের  পুরানো কাচের টুকরোর উপর পড়ে ওর ডান হাতটা কনুয়ের একটু নিচে বেশ খানিকটা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। আকাশ যন্ত্রনায় চিৎকার করে কাদতে লাগলো। ও রক্ত দেখে আরো বেশী ঘাবড়ে গিয়েছিল।

আকাশ জানে ওর বাবার কাছে সব প্রশ্নেরই জবাব আছে।

এযে কত বড় অসহনীয় যন্ত্রনা তা বোঝাবার শক্তি আমার নেই। আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। গ্যারেজে গাড়ী থাকা সত্ত্বেও, ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে প্রায় এক মাইল পথ অতিক্রম করে একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। আমি তখন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য।

আজ আমি আমার আকাশকে হারিয়েই ফেললাম। আমার আকাশকে চির দিনের জন্য আমি হারিয়ে ফেললাম। ওর এখন কত কাজ কত দায়ীত্ব। কত সাথী হবে আমার আকাশের। আমাকে ছাড়া দিন কাটাতে ওর আর কোন অসুবিধা হবে না। এইতো নিয়ম। সব আকাশই তো এমনি ছেড়ে চলে যায়। তায়তো পৃথিবী এগিয়ে চলে।

ব্যথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি কি করে ওকে বলবো—বাবা আমার কি হবে, আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন! গাড়ীর জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম।

           

 

জানো তুমি হে ভূস্বামী     জমি আমি কৃষক তুমি

যে বীজ বোনো          ফলাই শুধু তায়ই জেন।

মালিক তুমি সব তোমারি   আমি তো নই প্রতিহারী।

তোমার ফসল তুমি নেবে      জমি কেবল পুষ্টি দেবে।

আমি কেবল পুষ্টিদাতা         জানি যে তা হে বিধাতা!

ভরা ক্ষেত সব শুণ্য করে      তোল ফসল তোমার ঘরে

বুক যে আমার খাঁ খাঁ করে     সে খবর কি দেয় তোমারে!

দেয়ার ফাঁকে যে নেয়ার খেলা      চলে কেবল সারা বেলা

খেলার মাঝে তা কেউ খোজে না    শেষে না হলে কেউ বোঝে না।

খোকা এল আমার ঘরে     হাটি হাটি পা পা করে

কাদা মাটি শক্ত হলে         দেয় কি তাকে সব ভুলিয়ে?

খোকা কবে বড় হলো       হে বিধাতা তা তুমিই বলো

আমার খোকা আমার কোলে      ভারী হবে বড় বলে!

এই যদি হয়      তোমার বিচার

বল তবে       হে মহাকর? 

কেমন করে পাহাড় বুকে   জল পিপাসায় ধুকে ধুকে

ভারি কাঁধে মরুভূমি       দাড়িয়ে আছে মূক ধরণী !

আমি বাঁশি বাদক তুমি    যেমনি বাজাও বাজি আমি।

কি যে বাজাও       কি সুর সাজাও

তাত কেবল জানা তোমারি     হে কান্ডারি।

বলবে তুমি এটাই নিয়ম      চলছে অদি অনন্ত কাল

নিয়ম মেনেই চলবে সবি       উঠবে সূর্য্য হবে সকাল।

বলবে জানি হে বিধাতা  আমিও কারো আকাশ ছিলাম

সময় হলেই নিজের মত    নিজের জীবন গড়ে নিলাম।

এমনি করে আকাশ মাটির   খেলা খেলে কি লাভ পাবা

ফাঁদ পেতেছো পড়বো তাতে   আমরা যে সব মাটির বাবা।

আমারও আকাশ দিনে দিনে  এমনি ফাঁদে পড়বে কোন

তানা হলে দুনিয়া চলে     চলায় যে তার ব্রত যেন ।

সবই মানি তবু বাবা আমি   রক্ত মাংস হাড়ের খাচায়

দুনিয়া চলে নিয়ম বলে   কিন্তু মানুষ আমি তা ভোলা যায়!

খেলো তুমি সারাবেলা তোমার খেলা   শোন না তুমি কারো মানা

কেন খেলো নেই তা কারো জানা    জবাব জানি তুমি দেবে না।

শুধায় আমি হে মহাকর   রাজা তুমি রাজ্যে তোমার

পাথরেরতো নেইকো অভাব।

পাথর দিয়ে খেলো তুমি মনের সুখে   মিশিয়ে আকাশ মাটির বুকে

আবার নিয়ে যাওয়া এ কোন স্বভাব!

তাতে ছিড়লে কারো জীবনবীণা    জানি তোমার কিছু যায় আসে না!

বলবে তুমি হে অন্তর্যামী     সবকিছুরই হিসেব আছে তোমার কাছে

চলতে ভূবন চালাতে জীবন    এ সবেরও দরকার আছে।

আমিতো নই বিধাতা, নেই আমার অত হিসেব জানা

দুনিয়া চলবে না থমকে যাবে, তার খোঁজতো আমি রাখি না।

তোমার খেলা খেল প্রভু আমি অধম খেলব শুধু

খেলবো না, তা হয় কি   তায়তো কেবল সুর্য্য দেখি।

ডুববে যখন রবি   ঘুমের ঘোরে সাঙ্গ হবে সবি।

ঘুমের দেশে যেন আবার স্বপ্ন এসে   ভাঙায় না ঘুম অবশেষে

তোমার দান সে তোমার থাকুক   আকাশ মাটির খেলা শেষ হোক।

তুমি মনিব আমি চাকর   যদি সবই নেবে যা দিলে তার

তবে কেন দিলে তা আমারে।

থাকবে বসে সুখে দুখে    ছোট্ট আকাশ বাবার বুকে

তানা হলে মুক্ত কর এ দাসেরে।

Category: Bangla, Short Story

Comment List

Your email address will not be published.