দৈবক্রম – ৩
দিন ক্ষণ গুনে গুনে জীবন এগিয়ে চললো।
ট্রেনিং শেষে পোষ্টিং হলো আরিফের। ব্যস্ততা আর দায়িত্ব দুটোই বাড়লো। আর ওসবের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে সময় পার হতে লাগলো।
বেশ কিছুদিন পর একদিন দুপুর বেলা বসের অফিসে টেলিফোন আসলো আরিফের। বস ডেকে পাঠালেন ওকে।
টেলিফোন ধরলো আরিফ।
ওর শশুরের গলা!
চমকে উঠলো আরিফ। কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।
-আরিফ তোমার একটা মেয়ে হয়েছে বাবা।
একটু থামলেন তিনি। বোধহয় নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিলেন।
-মেয়েটা জন্ম দেয়ার অপেক্ষায় এতদিন অনন্যা তোমাকে তালাক দিতে পারিনি। এখন তালাক হয়ে গিয়েছে, তুমি কপি পেয়ে যাবে। অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই ও লন্ডনে চলে যাবে আর সেখানেই বিয়ে হবে ওর। তোমার মেয়ে আমাদের কাছেই থাকবে। ওর জন্য চিন্তা করো না। তোমার পরিকলল্পনা মোতাবেক নিয়ে যেও মেয়েকে।
শশুরকে অল্প বিস্তর যা দেখেছে তাতে তাকে খুব আন্তরিক এবং নিতান্তই সাদাসিদা মনে হয়েছে। তার কণ্ঠে আজকের এই রূঢ় বাস্তব কথাগুলো এক অনভিজ্ঞ অভিনেতার দেখে দেখে লিখিত স্ক্রিপ্ট পড়ার মতো শোনালো আরিফের কাছে।
একটা কথাও বললো না আরিফ। রিসিভারটা রেখে নিজের কক্ষে আসলো।
অনন্যা বা বিয়ে নামক ব্যপারটির জন্য ওর অনুভূতিগুলো ততোদিনে একদম ভোতা হয়ে গেছে। ওগুলো এখন নিরেট বাস্তবতা মাত্র। ওসম্পর্কে কোন কিছুই ভাবাবেগ জম্নাই না ওর মধ্যে।
ওর একটা সন্তান জন্ম নিয়েছে! তার তুলতুলে শরীরের ধমনীতে ওর নিজের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। ওর সন্তান যে ওর নিজের শরীরের অংশ।
কথাগুলো চিন্তা করতেই আনন্দ বেদনা মিশ্রিত এক অভূতপূর্ব অনুভূতি আরিফের শরীর মন ছাপিয়ে ওকে ভাবাবেগে আপ্লুত করে ফেললো।
এতদিনের জমাট বাধা অশ্রু আর কোন বাধা মানতে চায়লো না।
অন্যের কাছে প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে ভেবে তাড়াতাড়ি পিওনকে ডেকে দরজা বন্ধ করতে বলল আর শরীর খারাপের কথা বলে কাউকে রুমে আসতে নিষেধ করলো আরিফ।
গত রাতে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। আজ সারাদিন থেকে থেকে দমকা হাওয়া বইছে।
অফিসের অফিসের জানালার পাশেই একটা আম গাছ। ঝড়ে গাছের ছোট বড় ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়ে আছে। ঝড় বৃষ্টির ফলে গাছের নিচে ছোট ছোট গর্তে পানি জমেছে। ঝাপটা বাতাস প্রতিনিয়তই খোলা জানালার পর্দা এলোমেলো করছে।
আরিফ পর্দাটা এক পাশে গুজে দিয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসলো।
গাছের তলাটা ছোট ছোট আম আর আমের মুকুলে ভর্তি। মূক গাছটা অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে সেদিকে।
-এ কী নিষ্ঠুরতা প্রকৃতির, কোন মায়া দয়া নেই! ভাবল আরিফ।
– গাছটা কত যত্ন করে কত স্বপ্ন নিয়ে তার শাখা প্রশাখাকে ফুল ফল দিয়ে সাজাল আর একটা নিষ্ঠুর ঝড়ের জাপটা সব সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনাশ করল?
হটাৎ দুটো পাখীর কিচির মিচির শব্দ আরিফের চিন্তাই ছেদ ঘটাল। পাখী দুটো গাছের তলাই ওদের ছোট ছোট নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে পোকা মাকড় খাচ্ছিল। ওদের পাশেই একটা পাখীর বাসা ভেঙে পড়ে আছে।
আরিফ আরো একটু ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। বাসার পাশেই দুটো ভাঙা ডিম দুটো অফুটন্ত বাচ্চা সহ পড়ে আছে।
-ওই পাখী দুটোর বাচ্চা হয়তো। ভাবতেই আরিফের মনটা ব্যথাই ভরে গেল।
পাখী দুটো পাশে পড়ে থাকা অন্যান্য জিনিসের মত ওদের মরা বাচ্চা দুটোর গায়েও ঠোকরাল কয়েকবার।
-ওদের নিজের মৃত বাচ্চাদের আদর করে ঠোকরাচ্ছে না ওরা ঠোকরানোর মাধ্যমে বিলাপ করে বিধাতাকে অভিশাপ দিচ্ছে? আরিফ ভাবতে চেষ্টা করল।
পাখী দুটো কিচির মিচির শব্দ আবার আরিফের চিন্তাই ছেদ ঘটাল।
পাখী দুটো পাশের জমে থাকা জলে কিচির মিচির শব্দে আনন্দ করতে করতে স্নান করল কতক্ষণ। উপরে গাছের ডাল গুলো ফুল আর গুটি আমের ভার মুক্ত হালকা হয়ে মৃদু মন্দ বাতাসে আরামে দুলছে। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য হেলতে দুলতে থাকা ডাল গুলোর ভিতর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নিচে জমে থাকা জলের সাথে খেলছে।
এ এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক মহা মিলন।
পাখী দুটো তাদের পাখা ঝাপটা দিয়ে দিয়ে তাদের পাখনা গুলো শুখিয়ে নিচ্ছে আর একে অপরকে তাদের ঠোট দিয়ে পাখনা গুলো ঠিক করে দিচ্ছে।
গাছ পালা পাখী সব কিছুই সুন্দর পরিপাটি আর সতেজ দেখাচ্ছে।
সব ভুলে আবার নাতুন করে শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে পাখী দুটো উড়ে গেল।
একটা স্বর্গীয় সুখানুভুতি আরিফের মনকে উদ্বেলিত করল।
বাথরূমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্দ করলো আরিফ।
বেসিনের পানি ছেড়ে দিয়ে মন ভরে কাদলো আরিফ। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলো। বেসিনের পানির অবিরাম কল কল শব্দ আর ওর ফোঁপানো কান্নার শব্দ মিলে এক হৃদয় নিংড়ানো সুরমূর্ছনার অবতারনা করলো। যা ওর মনের কোণে কোণে জমে থাকা সব ব্যথা বেদনাকে ধুয়ে মুছে ওকে পাখির পালকের মত হালকা ফুরফুরে করে দিল।
কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেললো আরিফ।
বেসিনের শীতল পানিতে ভাল করে চোখ মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল। চিরূনী দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে অনেক দিন পর নিজেকে দেখলো ভাল করে।
এই প্রথম লক্ষ করলো দুএকটা সাদা চুল উকি ঝুকি দিচ্ছে।
হাসলো একটু। ভাবলো বয়স হয়েছে।
একটা সন্তানের বাবা ও এখন। কথাটা ভেবে আয়নায় নিজের চোখে তাকিয়ে যেন লজ্জা পেল একটু।
এক অজানা প্রশান্তিতে ওর সারা দেহ মন জুড়িয়ে যেতে লাগলো।
-নিশ্চয় অনন্যার মত দেখতে হয়েছে মেয়েটা!
ভাবলো মনে মনে। কিন্তু এই মুহুর্তে অনন্যার মুখটা কিছুতেই মনে করতে পারলো না। জোর করে ভুলতে ভুলতে স্মতিগুলো কেমন যেন ফ্যকাসে হয়ে গেছে।
নিজেকে আরো খুটিয়ে খুটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখলো আয়নার মধ্যে আরিফ।
-আমার মেয়ে, আমারই রক্ত, হয়তো আমার মতোই দেখতে হয়েছে।
আরিফ ভাবলো মনে মনে।
ভাবলো কি নাম রেখেছে কি জানি।
-মেয়েটাকে জন্ম দেয়ার জন্যই এতদিন অপেক্ষা করেছে, নাহলে আগেই ওকে ত্যাগ করে অন্যত্র বিয়ে করতো অনন্যা। কয়েক দিনের স্মৃতিকে মুছে ফেলে সব নতুন করে শুরূ করতো আবার।
যাক ওসব মৃত অতীতকে ভেবে কি হবে এখন!
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বুকটা খালি করলো আরিফ। যেন চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে চায়লো।
আনন্দ আর তৃপ্তিতে ভরা মুখে বেরিয়ে আসলো আরিফ। এখন ওর জীবন পরিপূর্ণ।
আহ কি শান্তি, কি দারূন অনুভূতি!
পিয়নের হাতে টাকা দিয়ে মিষ্টি আনতে বললো। মেয়ে হওয়ার কথা জানিয়ে সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো আরিফ। বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বসের রূমে যেয়ে তাকেও সংবাদটা জানালো।
বিয়ের প্রসঙ্গ পাড়লে বা বউ সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যে আরিফ বিরক্ত হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতো, মেয়ে হওয়ার সংবাদে সেই আরিফের মধ্যে এমন উতলে পড়া আবেগ দেখে অনেকে অনেক ধরণের মন্তব্য করলো।
কিন্তু তাতে আরিফের কিচ্ছু আসে যায় না। ওর জীবনটাও এখন অন্য দশ জনের মত স্বাভাবিক।
মাকে টেলিফোনে সব জানিয়ে যথাশিঘ্র সম্ভব মেয়েকে বাড়ী নিয়ে আসতে বললো আরিফ।
ছেলেকে আগের মত প্রাণবন্ত দেখে খুশি হলেন আরিফের মা সালমা বেগম। এ ব্যপারে যা করণীয় তার সব তিনি অতিসত্তর করবেন বলে টেলিফোনে ছেলেকে আশ্বস্ত করলেন।
I had a long career in Army. I was trained to follow orders, instructions and set rules, taking those as axiomatic. That strayed me a bit from free thinking as happens with all technology users. Basically I am a free thinker always and now in search of some basic truth in my own way. ([email protected]).
Just came from google to your website have to say thanks.
Good job for bringing something important to the internet!