দৈবক্রম – ২

দৈবক্রম     

২    

 

[email protected]

ভাবনার বাবা বড় সরকারী অফিসার। বদলীর চাকরী। প্রায় প্রতি বছরই মেয়ের স্কুল পরিবর্তন করতে হয় বদলীর কারণে। ভাবনা ম্যাট্রিক পাশ করতে কম করে হলেও ওকে সাতটা স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে। ক্লাসের বন্ধু বা শিক্ষকদের সাথে যখনই হৃদ্যতা গড়ে উঠতে শুরূ করে তখনই স্কুল ছাড়ার সময় হয় ওর।

প্রথম প্রথম খুবই কান্না কাটি করত ভাবনা স্কুলের বন্ধু বান্ধবদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হতো ওর।

-মা তুমি যখন বড় হবে তখন দেখবে দেশ জুড়ে তোমার অনেক বন্ধু বান্ধব। অনেক দিন পর কোন বন্ধুর সাথে হটাৎ করে দেখা হলে দেখবে কেমন ভালো লাগবে।

শান্তনা দেয়ার জন্য বাবা বুঝাতো মেয়েকে।

এখন মাঝে মধ্যে দুএকজন পুরোনো বন্ধুর সাথে হটাৎ দেখা হলে আসলেই খুব ভাল লাগে ভাবনার আর মনে পড়ে বাবার সেই কথাগুলো।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি পদক্ষেপেই বাবার কথাই মনে পড়ে ভাবনার। ওর জীবনের প্রায় সবটা জুড়ে আছে ওর বাবা। সেখানে দ্বিতীয় কারো স্থান নেই।

ভাবনা ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।

মা অনন্যা আর বাবা আরিফ সরকার একই শহরের বাসিন্দা। পড়াশোনাও করেছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিয়ের আগে চিনতো না কেউ কাউকে।

দুজনেই ইংরেজীতে মাষ্টার্স। তবে অনন্যা এক বছরের জুনিয়র আরিফের। অনন্যার মাষ্টার্স ফাইনালের আগেই দুপরিবারের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিয়ে হয় ওদের।

বিয়ের মাসখানেক আগে আরিফ সিভিল সার্ভিসে সিলেকশান পেয়ে এ্যডমিন ক্যডারে যোগদানের এ্যপোয়েন্টমেন্ট লেটার পায়। আরিফ চাকরীতে যোগদানের দু সুপ্তাহ আগে বিয়ে হয় ওদের।

বিয়েটা হয় অনন্যার নানার গ্রামের বাড়ীতে। অনেক জাইগা জুড়ে পুরনো জমিদার বাড়ি। অনন্যার নানার পরিবার জমিদার চিলেন।

দুপুরে বিয়েটা শেষ করে ওই দিন সন্ধ্যাই বউ নিয়ে রওয়ানা হওয়ার কথা আরিফের। কিন্তু রওয়ানা দেয়ার কিছুক্ষণ আগে খবর আসলো যে মেইন রাস্তার একটা ব্রিজ ধ্বসে পড়ায় গাড়ী চলাচল বন্ধ।

ওদের যাওয়া হলো না সেদিন। অন্যান্য সবাই ট্রেন বা বাসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্নি করার মনোস্ত করে যাত্রা করল।

শশুর বাড়ীতেই আয়োজন করা হলো ওদের বাসর রাতের।

 

চাকুরীতে জয়েন করার জন্য আরো কয়েকটা দিন সময় হাতে আছে তাই আরিফের পক্ষ থেকে ফেরার তেমন তাড়াও ছিল না। প্লান হলো এদিকে কোথাও হানিমুন ট্রিপে যাবে ওরা।

টেলিফোনে সব ঠিকঠাক করে ওরা ধারে কাছে সমুদ্র সৈকতে গেল হানিমুন কাটাতে।

তিন দিন ছিল ওখানে। সামাজিক ভাবে ঠিক ঠাক করা বিয়ে ওদের। তায় একে অপরকে জানা আর জানানোর অনেক কথা ছিল। জীবন সঙ্গীর কাছে জীবনের ঘটে যাওয়া সব কথা, ব্যথা বেদনা, স্মরণীয় মুহুর্ত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ইত্যাদি ওরা একে অপরের মধ্যে ভাগাভাগি করে ওদের মধ্যকার অচেনার ক্ষেত্রটা কমিয়ে আনতে আনতে একদম নিঃশ্বেষ করে ফেলতে চায়লো।

যা কিছু বলা যায় তার সবকিছুই বললো ওরা দুজন দুজনকে।

একে অন্যকে কখনো একটুও ঠকাবে না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধও হলো।

অনন্যার মা নাসিমা মন্ডল একজন রাজনৈতিক বাক্তিত্ব। বিয়ের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই লন্ডনে গিয়েছিলেন বড় ছেলের বাড়ীতে।

বলতে গেলে তিনিই একক সিদ্ধান্তে বিয়েটা ঠিক করেছিলেন। জামাই হিসেবে আরিফ আর ওদের পরিবারকে খুব পছন্দ হয়েছিল নাসিমা মন্ডলের। বিয়ের সময় লন্ডন থেকে টেলিফোনে আর্শিবাদ করলেন মেয়ে জামাইকে।

লন্ডনে সব কাজ সেরে মেয়ের বিয়ের আরো প্রায় দুসপ্তাহ পরে দেশে ফেরত আসার কথা নাসিমা মন্ডলের। কিন্তু তিনি হটাৎ লন্ডনের সব রাজনৈতিক প্রগাম বাতিল করে ওদের বিয়ের চার দিনের দিন দেশে ফিরলেন নাসিমা মণ্ডল।

হানিমুন থেকে ফিরে আরিফ আর অনন্যা মায়ের ফিরে আসার খবরটা শুনলো। মায়ের মত ব্যস্ত মানুষের এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা আর একদম সরাসরি এখানে আসাটা একটু অবাক করলো অনন্যাকে।

আরিফকে সাথে নিয়ে পাশের ঘরে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো অনন্যা। কিন্তু অনন্যার বাবা সরোয়ার মন্ডল মুখটা শুখনো করে খুব অল্প কথায় নাসিমার শরীর মন দুটোই খারাপ জানিয়ে অনন্যাকে নিবৃত করলেন।

অনন্যা আর আরিফ দুজনেই অবাক হলো।

অগত্য আরিফকে বিশ্রাম নেয়ার কথা বলে বাবার সাথে বাইরে গেল অনন্যা।

 

তারপর অনন্যা আর আসলো না আরিফের সামনে।

হতবাক হলো আরিফ যখন শুনলো যে অনন্যা ওর সাথে দেখা করতে চায় না। কেউ পরিষ্কার করে কিছু বললোও না ওকে।

বিয়েতে যারা এসেছিল অর্থাৎ ওর সব আপনজনেরা তারা সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেছে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের পর পরই। এখানকার সবাই ওই বিয়ের সুত্রেই ওর আপনজন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে সে সুত্রের সরু সুতোটা কোন এক হেচকা টানে যেন ছিড়ে পড়েছে।

 

যদিও আরিফ এবং অনন্যা একই ইউনিভার্সিটিতে প্রাই চার বছর একসঙ্গে পড়াশুনা করেছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ওরা কেও কাওকে চিনত না। এটা ওদের নিজেদের কাছেও অবাক করা কাণ্ড বলে মনে হয়েছিল যা ওরা হানমুনের সময় আলোচনা করে হাসা হাসিও করেচিল।

-আমি বোধহয় দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত সুন্দরী ছিলাম না।

-সে রকম নয় অনন্যা। আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে অস্বচ্ছ কাচের জানালার মত। ওটা সুন্দর দেখাই যখন ভিতর থেকে আলোটা জ্বলে। রাত যত কাল সৌন্দর্যটাও ততো বেশি। বাইরের সৌন্দর্য প্রকৃত নয়, ওটা কৃত্তিম ভাবে সাজানো। ভিতরের সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য যার মধ্যে ডুবে থাকা যাই।

-তুমি বলতে চাও কোন মেয়েই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি? অনন্যা ব্যাপারটাকে হাল্কা করতে চাইল।

-আমি তেমন বলছি না। কোন কোন ক্ষেত্রে কারো চোখ বা চুল হইতো ভাল লেগেছে বা কারো হাসি।

-তার পর?

-ও গুলো হয়তো ভিতরের কিছুর প্রকাশক হতে পারে, কিন্তু আমি তা নিয়ে গবেষনা করিনি কখনো।

অনন্যা হাসল কোন মন্তব্য না করে।

বর্তমান পরিস্থিথিতে সেসব কথা ভাবতে যেয়ে আরিফের মনে হল –মন্তব্য না করার মানে কি, তাহলে কী অনন্যা কথাটা পছন্দ করেনি?

-তুমি কোন মেয়েকে কখনো ভাল বেসেছিলে? অনন্যার প্রশ্নে আরিফ একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল।

-আমি মজা করছি, এর জবাব তো তুমি আগেই দিয়েছ। জোরে জোরে হাসল অনন্যা।

-মলি মাডামকে আমার খুব পছন্দ ছিল।

-মলি মাডাম যিনি ইংরেজি কবিতা পড়াতেন?

-হ্যাঁ।

-তিনি তার পাচ ছয় বছরের মেয়াকে নিয়ে কলেজের কুয়ার্টার এ একা থাকতেন স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে।

-হা, আমি ওনার কথাই বলছি। ওনার মুখের অভিব্যক্তিতা অনেক কথা বলত। ওনার সম্পর্কে জানলে ওনার মুখ দেখে একরকম মনে হত, আর না জানলে অন্য রকম। সময় পেলেই আমি ওনার বাসাই জেতাম।

-আমিও ওনার বাসাই অনেক বার গিয়েছি।

 

-অনন্যা আর কখনো তোমার সাথে দেখা করবে না। অনন্যার বাবার কণ্ঠস্বর অনন্যার সাথে কাটন তিন দিনের সব কথা এক এক করে খুঁটিয়ে দেখতে মগ্ন আফিরকে একটা ধাক্কা দিল।

এতকিছুর মাথামুণ্ড– কিছুই বুঝলো না আরিফ। বাকি সব পরে ওকে জানানো হবে বলে সরোয়ার মণ্ডল আর এক মুহুর্তও দাড়ালেন না সেখানে।

 

কি করবে আরিফ এখন! কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে সে কথা। ওদিকে বাড়ীতে নতুন বউকে বরন করার জন্য সব আয়োজন চলছে। কিন্তু এ মুহুর্তে অনন্যা এই বিশাল বাড়ীটার কোন কোনে যে লুকিয়ে আছে তায় বা কে জানে।

এক মুহুর্তের মধ্যে এ বাড়ীর সব মানুষ যেন ওর দৃষ্টিসীমা এড়িয়ে চলতে শুরূ করলো। এখানে অবাঞ্চিত ও এখন।

এক কাপড়ে এক রকম পালিয়ে গেল আরিফ।

অনন্যার এহেন আচরণ দারূন ভাবে আহত করলো আরিফকে। মনে একটা নিদারূন ব্যথা নিয়ে ফিরে এলো আরিফ। অনন্যাকে সাথে করে না আনার ব্যপারে পরিষ্কার করে কাউকে বললো না কিছুই।

বলবেই বা কি, প্রকৃতপক্ষে ও নিজেও জানে না কিছুই।

একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই কয়েকদিন পর চাকরীতে যোগদানের জন্য চলে গেল আরিফ।

মনের কষ্টে আর অভিমানে অনন্যার সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টাও করলো না। আর এ ব্যপারে ওর শশুর বড়িীর পক্ষ থেকেও চেষ্টা করলো না কেউ।

বিয়ের পর তিন দিনের হানিমুনে আরিফ আর অনন্যা এতদিন যা কিছু ওদের একান্ত নিজের ছিল তার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে একে অন্যকে। ওদের সব ভাবনা সব পরিকল্পনা ওই কয় দিনে এক সুতোয় গেথেছে ওরা।

কিন্তু কি এমন হলো ওই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে যা অনন্যাকে অমন পরিবর্তন করে দিল!

শুরূ না হতেই জীবনটা অর্থহীন প্রতারনাপূর্ণ হয়ে গেল!

Category: Bangla, Novel

Comment List

Your email address will not be published.